Image description

গভীর রাতে পুরো গ্রাম যখন ঘুমে নিস্তব্ধ তখনও আর্তনাদ থামে না নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার সাইলকোনা গ্রামের তরুণ মোস্তফার। তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করেন তিনি। সেই চিৎকারে ঘুম ভাঙে প্রতিবেশীদের, ভিজে ওঠে তাদেরও চোখের কোনও। প্রচন্ড শারীরিক যন্ত্রণার সাথে মোস্তাফার প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে ঝরছে পুঁজ আর রক্ত। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ২-৩ ঘণ্টা কিছুটা স্বস্তি পান, বাকি সময় কাটে নরকযন্ত্রণায়।

নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার সাইলকোনা গ্রামের কৃষক ছায়দুর রহমান ও রাবেয়া বেগম দম্পতির একমাত্র ছেলে মোস্তফা আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সাধারণ মানুষের মতো দুটি নয়, মোস্তফার শরীরে রয়েছে তিনটি কিডনি। এই বিরল শারীরিক গঠনই আজ তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুল চিকিৎসা, অর্থের অভাব আর শারীরিক জটিলতায় ধুঁকতে থাকা এই তরুণ এখন জানাচ্ছেন কেবলই বাঁচার আকুতি।

বছর খানেক আগেও যে মোস্তফা ক্রিকেট আর ফুটবল নিয়ে মাঠ দাঁপিয়ে বেড়াতেন, তিনি আজ বিছানায় শায়িত। বাগাতিপাড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১৯ এইচএসসি পাস করা মোস্তফা ছিলেন দারুণ হাসিখুশি। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দাপটের সাথে ক্রিকেট খেলেছেন। অভাবের সংসারে হাল ধরতে নিজের ও ৬ বছরের শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে আজ তার সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে।

চলতি বছরের শুরুর দিকে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন মোস্তফা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, তার একটি স্বাভাবিক কিডনির পাশাপাশি আরও দুটি ছোট যমজ কিডনি রয়েছে। প্রতিটি কিডনি থেকে আলাদা ইউরেটার মূত্রথলিতে যুক্ত। 

মোস্তফা বলেন, ঢাকায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা জানান জমজ কিডনি দুটির একটিতে পানি জমেছে। যা অস্ত্রোপচার করলে ঠিক হয়ে যাবে। সুস্থ হওয়ার আশায় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৩ লাখ টাকা খরচ করে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে, অস্ত্রোপচারের পর মোস্তফা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।

পরিবারের অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সময় ক্ষতিগ্রস্ত একটি কিডনির কিছু অংশ শরীরে রেখে দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে ভয়াবহ সংক্রমণের সৃষ্টি করে। এরপর মোস্তফার শরীরে আরও দুই দফা অস্ত্রোপচার করেও কোনো কাজ হয়নি। বর্তমানে তার শরীরে ‘সিউডোমোনাস’ নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে এবং অধিকাংশ ওষুধই আর কাজ করছে না। তার প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে অনবরত পুঁজ বের হচ্ছে। দেশে চিকিৎসার আর কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

মোস্তফার চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে পরিবারটি আজ পথে বসার উপক্রম। চিকিৎসায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে বিক্রি করতে হয়েছে শেষ সম্বল জমি ও গবাদিপশু।
 
মোস্তফার মা রাবেয়া বেগম বলেন, ছেলের কান্না আমি আর সহ্য করতে পারি না। যন্ত্রণায় যখন ও মা গো বলে চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়, তখন মনে হয় আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। ভেজা গামছা দিয়ে বুক-পেট মুছে দিই, যেন একটু যন্ত্রনা কমে। আমার এই একটা ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। আপনারা দয়া করলে আমি আমার মানিককে বাঁচাতে পারবো।

মোস্তফার স্ত্রী স্বামীর জীবন বাঁচাতে সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন চিকিৎসা করে পরিবারের সহায়-সম্বল যা ছিল সব শেষ। খেয়ে না খেয়ে স্বামীর চিকিৎসা করেছি। বর্তমানে আমাদের আর কিছুই নেই। আমাদের একার পক্ষে চিকিৎসা চালানো আর সম্ভব হচ্ছে না। ওর কিছু হলে আমাদের দেখার মতো কেউ থাকবে না। সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় হয়তো আমার স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব।

মোস্তফার প্রতিবেশী রশিদা বেগম জানান, মোস্তফার চিৎকারে এলাকার মানুষও রাতে ঘুমাতে পারেন না। ছোটবেলা থেকে সবার চোখের সামনে বড় হওয়া হাসিখুশি ছেলেটির এমন পরিণতি কেউ মেনে নিতে পারছেন না। মোস্তফার চিৎকার সহ্য করতে না পেরে প্রতিবেশীরাও কান্না করে।

মোস্তফার দাদি রাবেয়া বেগম বলেন, দুই বছর বয়সে মোস্তফার একবার সমস্যা হয়েছিল। চিকিৎসা করে তখন ভালোও হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় যাওয়ার পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখন সারাদিন শরীরের যন্ত্রণায় চিৎকার করে। প্রস্রাব করতে গেলে করতে পারে না।

মোস্তফার এমন পরিণতি দেখে নিজেদের সাধ্যমতো তার পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রতিবেশী ও এলাকাবাসী। গ্রামবাসীর সহায়তায় মোস্তফার পাসপোর্ট করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার বিশাল অঙ্কের টাকা। 

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এএসএম লেলিন বলেন, মোস্তফা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে আজ মৃত্যু পথযাত্রী। সে আমার গ্রামের সন্তান। তার কৃষক বাবা নিজের সবটুকু দিয়ে তার চিকিৎসার চেষ্টা করেছে। আমরাও আমাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছি। সকলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে ছেলেটা হয়তো আবারও সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

মোস্তফাকে সহযোগিতা করতে যোগাযোগ করা যাবে ০১৩১৮-১১৯৪৬৫ নম্বরে।