Image description

তিনি খলনায়ক। প্রভাবশালী নেতা হিসেবেও পরিচিতি আছে তার। তিনি আবার দানবীরও। বাংলা চলচ্চিত্রে নিজস্ব ঢঙে নানা রসের সংলাপ ছুড়ে আলাদা স্থান করে নিয়েছেন।

সাধারণ দর্শক-শ্রোতার একটি অংশ তার সংলাপ শুনে কাঁপে। অনেকে তাই মজার ছলে তাঁর সংলাপ অহরহ আওড়ায়। নিজ এলাকা ঢাকার গাবতলীসহ বিভিন্ন স্থানে হাত খুলে দান করার খ্যাতি জুটেছে বহু আগেই। ‘অনেক’ গুণের জন্য অনেকে ‘খাতির’ করলেও নিজের চার বোন ‘গুণধর’ ভাইয়ের এসব খ্যাতি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন।
 
তাঁদের কাছে তিনি প্রতারক। এত দিন তাঁদের বুক ফেটেছিল, মুখ ফোটেনি। তবে এবার ঘরের পর্দার বাইরে এসে প্রকাশ্যে মুখ খুলেই বলছেন, এই ভাই তাঁদের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ আত্মসাৎকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই ‘অপকর্মে’ অবশ্য তিনি অন্য এক ভাইকেও সঙ্গে রেখেছেন।
 
এই নিন্দনীয় ‘কাজের কাজি’ হলেন মনোয়ার হোসেন ডিপজল। 

প্রায় ৪০ বছর ধরে দাদার রেখে যাওয়া ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভোগদখলে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চার বোনকে তাঁদের প্রাপ্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদের অধিকার না দিয়ে বেশির ভাগ নিজেই ভোগদখল করছেন। জমি বিক্রি করছেন প্যাকেজ আকারে। তবে ডিপজল তাঁর বোনদের তোলা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এ অবস্থায় নূরজাহান বেগম লায়লাসহ বঞ্চিত বোনরা ডিপজলসহ তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে গত মাসে আদালতে মামলা করেছেন। এ ছাড়া গত বুধবার রাতে রাজধানীতে নিজেদের বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে ডিপজলের বিরুদ্ধে ভূমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন বোনরা। ডিপজলের জ্বলজ্বলে ভাবমূর্তির মুদ্রার পিঠ উল্টিয়ে তাঁরা জানান, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরেই পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে চার বোনকে বঞ্চিত রেখেছেন ডিপজল। গত বুধবার বাধ্য হয়ে ক্যামেরার সামনে এসেছেন তাঁরা। অধিকার না পাওয়ার কথা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁরা। 

ডিপজলের ভুক্তভোগী চার বোন হলেন নূরজাহান বেগম লায়লা (বড়), সেলিনা বেগম (মেজো), মোসা. পারভীন (সেজো)। এ ছাড়া মোসা. জিয়াসমিন নামে ডিপজলের ছোট আরো এক বোন আছেন।

নিজেদের প্রাপ্য ২ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি ফিরে পেতে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ডিপজল এবং তাঁর অন্য দুই ভাই আনোয়ার হোসেন আফজল ও মৃত শাহাদাত হোসেন বাদশার বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ করেন বোনরা। বাবার সম্পত্তিতে ৪০ বছরের বঞ্চনা ও ডিপজলের আত্মসাৎ নিয়ে তাঁদের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। 

ডিপজলের সেজো বোন মোসা. পারভীন জানান, তাঁদের বাবা সোহরাব হোসেন মারা যান ১৯৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর। বাবার রেখে যাওয়া প্রায় ২০০ বিঘা জমি, সিনেমা হল (এশিয়া ও পর্বত), পেট্রল পাম্প, ব্রিক ফিল্ডসহ মোট সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী, এই সম্পত্তিতে বোনদের প্রাপ্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। 

পারভীন অভিযোগ করেন, ৪০ বছর ধরে ভাইয়েরা, বিশেষ করে ডিপজল টালবাহানা করে তাঁদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে আসছেন। বাবার মৃত্যুর পর বেঁচে থাকা অবস্থায় মা মৌখিকভাবে কিছু সম্পত্তি ভাগ করে দিলেও ভাইয়েরা বোনদের কোনো দলিল বুঝিয়ে দেননি। উল্টো ডিপজল তাঁর পেশিশক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাবার সম্পত্তি ভোগদখল করছেন এবং গোপনে ‘প্যাকেজ’ আকারে জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। সম্পদ কুক্ষিগত করতে ডিপজল এবং তাঁর ভাইয়েরা জন্মদাত্রী মা জবেদা বেগমের সঙ্গেও চরম অমানবিক আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ করেন তাঁদের বোন পারভীন। 

পারভীন বলেন, বাবার মৃত্যুর পর তাঁর মাকে গাবতলীর পর্বত সিনেমা হল সংলগ্ন বাবার বাড়ির নিচতলায় (আন্ডারগ্রাউন্ডে) একা ফেলে রাখা হয়েছিল। সেখানে ভাইয়েরা থাকতেন ওপরতলার আলিশান ফ্ল্যাটে। 

কালের কণ্ঠের প্রতিনিধির সঙ্গে কথোপকথনে পারভীন প্রশ্ন তোলেন, ‘ডিপজল ভাইকে জিজ্ঞাসা করবেন, মা ভক্ত ছেলেটা তার মাকে এক বেলা ভাত খাওয়াইছে কি না?’ এমনকি প্রায় ১১ বছর আগে মা মারা যাওয়ার পর মেজো ভাই (শাহাদাত হোসেন বাদশা) মায়ের জানাজায়ও অংশ নেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। 

ডিপজলের ‘দানবীর’ ভাবমূর্তিকে ‘লোক-দেখানো’ ও ‘রাজনৈতিক চাল’ বলে অভিহিত করেছেন তাঁর বড় বোন নূরজাহান বেগম লায়লা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত রমজানে ডিপজল ট্রাক ভরে ভরে ইফতার ও কাপড় বিলি করে বেড়াচ্ছিল। অথচ তার আপন ভাগ্নে প্রিন্স (নূরজাহানের ছেলে) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছে। তাকে ডিপজল একটি টাকাও দেয়নি।’

নূরজাহান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তাঁর ছেলের চিকিৎসার জন্য মাত্র ২০ লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল। তিনি কোটি টাকার ফ্ল্যাটের দলিল বন্ধক রেখে ভাবির (বাদশার স্ত্রী) কাছে টাকা চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। বাধ্য হয়ে ছেলের চিকিৎসার খরচ জোগাতে শেষ সম্বল ফ্ল্যাটটি মাত্র ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘যে ভাই-বোনদের ‘হক’ দেয় না, সে বাইরে দান করে বেড়ায় শুধু নাম ফোটানোর জন্য।’ 

ডিপজলের বোনরা অভিযোগ করেছেন, কোনো ধরনের বাটোয়ারা ছাড়াই ডিপজল এবং তাঁর ভাইয়েরা একের পর এক পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন। পারভীনসহ অন্য বোনেরা অভিযোগ করেন, বড় ভাই জালিয়াতি করে দীপনগরে (গাবতলী, মিরপুর, ঢাকা) ২৩ বিঘা ইটভাটার ১৩ বিঘা জমি বিক্রি করেছেন হাজি শাহাদাত হোসেনের কাছে। সরকারের জমি অধিগ্রহণের আড়াই কোটি টাকা তিন ভাই (ডিপজল, আফজল ও বাদশা) মিলে আত্মসাৎ করেছেন। তার কোনো ভাগ বোনদের দেননি। সাবেক এমপি আসলামুল হকের কাছে জমি বিক্রির চার কোটি টাকাও বোনদের না দিয়ে ভাইয়েরা আত্মসাৎ করেছেন। ডিপজল গাড়ির ব্যবসার কথা বলে জমি বিক্রির টাকা নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। বর্তমানে আবারও গোপনে জমি বিক্রির পাঁয়তারা চলছে জেনে বোনরা আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। 

ডিপজলের মেজো বোন সেলিনা, ২৭ বছর ধরে পর্দার আড়ালে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই আজ আমাকে পর্দা থেকে বের হতে বাধ্য করেছে। সে যদি আমার হক দিত, তবে আমি আজ মিডিয়ার সামনে আসতাম না।’ 

পারভীন ও সেলিনা জানান, তাঁদের বাসার বাইরে যাওয়া অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে তাঁদের ভয় দেখানো হচ্ছে। আদালতের নির্দেশে সম্পত্তিস্থলে তাঁরা যে সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন, ডিপজলের লোকজন তা সরিয়ে ফেলেছে। সেলিনা বলেন, ‘আমরা অসহায়, আমাদের পিস্তল নেই, টাকা নেই। আমরা শুধু আমাদের জানের নিরাপত্তা চাই।’ 

ডিপজলের বড় বোন নূরজাহান বেগম লায়লা ডিপজলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোরা প্যাকেজ বিক্রি করছিস, আমাদেরটা আমাদের দিয়ে দে। তা না হলে আমরা মরে গেলে হাশরের মাঠে তোদের জবাব দিতে হবে।’

জানা গেছে, বঞ্চিত বোনরা গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দলিল বাতিলের মোকদ্দমা দায়ের করেছেন (মামলা নম্বর দেওয়ানি ৭৪৩/২০২৫)। প্রায় দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকার পৈতৃক ভূসম্পত্তি উদ্ধারে এ মামলা করা হয়। মামলার বাদীরা হলেন সেলিনা বেগম, মোসা. নূরজাহান বেগম, মোসা. জিয়াসমিন ও মোসা. পারভীন। মামলায় বিবাদী করা হয়েছে মনোয়ার হোসেন (ডিপজল), আনোয়ার হোসেন (আফজল) এবং মৃত ভাই শাহাদাত হোসেন বাদশাকে। বর্তমানে বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। বোনরা সরকারের হস্তক্ষেপ ও দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন যেন তাঁরা এই প্রভাবশালী ভাইদের গ্রাস থেকে নিজেদের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা ফিরে পান।

ডিপজল নাকচ করেছেন অভিযোগ

ডিপজল বোনদের সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। চার দিন আগে তিনি নিজের ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘সম্প্রতি আমার কিছু বোন আমাকে নিয়ে যে মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে, তার বিষয়ে আমি আপনাদের সামনে কিছু বাস্তবতা তুলে ধরতে চাই। প্রথমেই পরিষ্কার করে বলতে চাই, এই বক্তব্য দেওয়ার উদ্দেশ্য কাউকে অসম্মান করা নয়, বরং আমার প্রতি ছড়ানো ভুল ধারণা ও মিথ্যা অপবাদের বিষয়ে সত্য তুলে ধরা। মামলার আইনি জবাব আমি আইন অনুযায়ী দেব, ইনশাআল্লাহ।’ 

তিনি লেখেন, ‘আমার বোনদের আমি সব সময় সম্মান, ভালোবাসা ও সাধ্যমতো সহযোগিতা করে এসেছি, এ কথা আমার এলাকার মানুষ ও আশপাশের পরিচিত সবাই জানেন। একজন বোন ক্যামেরার সামনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, তাঁর অসুস্থ সন্তানের খোঁজ কেউ নিইনি। অথচ তাঁর সন্তানের চিকিৎসার জন্য আল্লাহর দেওয়া সামর্থ্য অনুযায়ী আমি আমার পক্ষ থেকে একটি বড় অঙ্কের সহায়তা করেছি এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। আজ ক্যামেরার সামনে তিনি যেন সব ভুলে গেলেন! পর্দায় অভিনয় আমি করি, বাস্তব জীবনে নয়। যদি জানতাম কোনো দিন বাস্তব জীবনে এমন অভিনয়ের সম্মুখীন হতে হবে, তাহলে হয়ত প্রতিটি কাজের প্রমাণ রেখে দিতাম। আরেক বোন বলেছেন, ১১ বছর ধরে না কি আমার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। অথচ মাত্র দুই মাস আগেই তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ সাহায্য করা হয়েছে।’ তিনি প্রশ্ন করেন, ‘৩৫ বছর পর আজ হঠাৎ তারা কেন এবং কার প্ররোচনায় এমন মিথ্যা বলছেন-এ প্রশ্ন আমারও আছে। যদি সত্যিই কোনো দাবি থাকত, ভালোবাসার সম্পর্ক ধরে সরাসরি বললেই আমি তাদের দু-তিন গুণ বেশি দিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলাম। আমি ডিপজল, আমার সাধ্যের মধ্যে কাউকে ফিরিয়ে দিই না আল্লাহর রহমতে, আর তারা তো আমার আপন বোন। যে বোন পর্দা করেন বলে প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমি আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করেছি, সেই বোনের মুখেই আজ এমন কথা শুনতে হলো, এটা সত্যিই কষ্টের।’