অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্র করে পাল্টে যাচ্ছে দেশের চিরাচরিত রাজনীতির কাঠামো। দীর্ঘ আন্দোলনের সঙ্গী হচ্ছে প্রতিপক্ষ। আবার মতভিন্নতায় বিভিন্ন সময় ভেঙে যাওয়া দলগুলো নতুন করে হচ্ছে জোটবদ্ধ। শক্তি সঞ্চয় করে আগামী নির্বাচনে নিজেদের পাল্লা ভারী করতেই মূলত এসব তৎপরতা।
পর্দার আড়ালে প্রতিদিনই হচ্ছে বৈঠক। চলছে সমঝোতার চেষ্টা। ছোট দলগুলোকে নিজেদের ছাতার নিচে নিয়ে শক্তি বাড়াতে তৎপর বড় দলগুলো। আবার ছোট দলগুলোর দৌড়ঝাঁপ বড় ছাতার দিকে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণ গণনা শুরু হচ্ছে আজ থেকে। নির্বাচন কমিশন সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণা করবে। আর এর মধ্য দিয়েই মাঠে গড়াচ্ছে নির্বাচনমুখী রাজনীতি। নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী এ নির্বাচনে ভোট নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। আর ভোটের ওই হিসাব মেলাতে নির্বাচনি জোট গড়তে চলছেও নানা তৎপরতা।
২০২৪ এর জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর মূলত পাল্টে গেছে রাজনীতির খোলনলচে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিবর্তনের গতি আরও বাড়িয়েছে। আওয়ামী শাসনামলের ১৭ বছরে এক কাতারে থেকে আন্দোলন ও সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। প্রায় ২৬ বছরের পুরোনো সঙ্গী বিএনপি-জামায়াত। ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে ২০০১-এর নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে জয়লাভ করে। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের (জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোট) কাছে পরাজিত হয়। এরপর ২০১২ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সম্প্রসারণ করে ১৮ দলীয় জোট ও পরে আরও ২টি দল যোগ করে ২০ দলীয় জোট গঠন করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে জোট থেকে বিভিন্ন দল যোগ-বিয়োগ হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দীর্ঘ রাজনীতির সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনি মাঠে বিএনপি কীভাবে দেখবে এতদিন তা নিয়ে ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর টানাপোড়েন। কিন্তু তফসিল ঘোষণার মাত্র চার দিন আগে ৭ ডিসেম্বর জামায়াতকে নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফলে সারা দেশের দলীয় নেতা-কর্মীরা ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা এখন নির্বাচনি প্রস্তুতিতে জামায়াতকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা শুরু করেছেন। এতে নির্বাচনি মাঠ সরগরম থাকবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, এরই মধ্যে ভোটকেন্দ্রিক পাঁচটি দল সক্রিয় হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি রাজনৈতিক জোট এখনো সক্রিয় রয়েছে। এ জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন নিয়ে আলোচনা চলছে বিএনপির। এ জোটের বিপরীতে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বে আট দলের জোট নির্বাচনি মাঠে তৎপরতা শুরু করেছে। এ জোটে আরও কয়েকটি ইসলামী দলকে যুক্ত করার চেষ্টা আছে। সম্প্রতি এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনকে নিয়ে তিন দলের জোট গঠন করেছে গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি। এ ছাড়া অতীতে মতভিন্নতায় ভেঙে যাওয়া জাতীয় পার্টির একাংশ, জাতীয় পার্টি-জেপির নেতৃত্বে ১৮ দলের একটি জোটেরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। গত মাসের শেষদিকে বাম প্রগতিশীল ৯টি দলের সমন্বয়ে আরও একটি জোট গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই পাঁচ জোটের বাইরে থাকা দলগুলোও কোনো না কোনো জোটে অংশ নেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। চলছে আসন নিয়ে দরকষাকষি। এনসিপির সঙ্গে জোট গঠনের আলোচনা থাকলেও নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে গণ অধিকার পরিষদ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। দলটির একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি জোট করার পক্ষে। আট দলের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ রয়েছে।
রাজনীতির এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে প্রতিযোগিতা না বলে দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী। যুক্তি তুলে ধরে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি হচ্ছে বিনিয়োগের একটি বিষয়। এটাকে নিরাপদ করতে নির্বাচনে জয়লাভকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে নির্বাচন প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি দল নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকবে। কিন্তু রাজনীতির সংস্কৃতি কিন্তু বদলায়নি। তাই আগামী নির্বাচন সহিংসতা হবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।