এক সময় ‘লাখোপতি’ শুনলে মানুষ মনে করতেন বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক। যার লাখ টাকা রয়েছে সেই লাখোপতি। পরবর্তীতে সেটা বাড়িয়ে ‘কোটিপতি’ হয়। মানুষের মধ্যে বলাবলি হতো উনি কোটি টাকার মালিক (কোটিপতি)। এখন সারাবিশ্বের মানুষের মতো বাংলাদেশের বিত্তবানদের সংখ্যাও বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ নানাভাবে মানুষ অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ছে। এখন গণিতের টাকার অংকের বদলে ডলারের অংশে অর্থের হিসাব হয়। মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন, কোয়াড্রিলিয়ন এবং কুইন্টিলিয়ন অর্থের হিসাব হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেকেলে হিসেবে ‘কোটিপতি’তে পড়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়, দেশে এতজন কোটিপতি রয়েছে।
ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন মাত্র পাঁচটি। সময়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকা- বাড়তে থাকায় এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ে। ১৯৯০ সালে ছিল ৯৪৩টি, ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩টি। এরপর ২০২০ সালে ৯৩ হাজার ৮৯০টি এবং ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় এক লাখ ২২ হাজার ৮১টিতে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শেষে এই সংখ্যাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার।
এদিকে ১৯৯০ সালের দিকে ২২ ক্যারেট সোনার দাম প্রতি ভরি প্রায় চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা এবং ২০০০ সালের দিকে তা বেড়ে প্রায় আট হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা হয়। বর্তমানে ২২ ক্যারেট এক ভরি স্বর্ণের দাম দুই লাখ ১১ হাজার টাকার বেশি।
অপরদিকে, ৯০ দশকে অনেক গ্রামীণ এলাকায় এক শতাংশ জমির দাম ১০০ থেকে ৫০০ টাকা বা তারও কম পরত, যা এখন লাখ টাকায় পৌঁছেছে।
ওই সময় রাজধানী ঢাকার অনেক আবাসিক এলাকায় এক শতাংশ জমির দাম ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। এখন যা কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু স্বর্ণ বা জমির দামের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এমন নয়; ডলারের দামেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ১৯৯০ সালে এক ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ৩৩-৩৫ টাকা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। যেমন- ১৯৭৮ সালে এক ডলারের বিপরীতে টাকা ছিল ১৫ টাকা ২২ পয়সা। যা এখন ১২২ টাকার বেশি।
প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান বাজারে এক কোটি টাকার মালিক কোন পর্যায়ে পড়ে? ছোট ছোট ব্যবসা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান যারা পরিচালনা করেন তাদের কেউ কেউ ১৫-২০ কোটি টাকার এলসি খোলেন ব্যবসায়িক কাজে। বড় শিল্প গ্রুপ কয়েকশ কোটি টাকার এলসি খোলেন। কয়েক বছরে দেশের বাজেট শতগুণ বেড়েছে। দেশে প্রায় এক লাখ শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। সেগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-লেনদেন হচ্ছে। এক সময় একটি ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার দুই হাজার টাকা মাসিক বেতন পেতেন; এখন দুই থেকে তিন লাখ টাকাও বেতন পান। একটি পিয়নের চাকরি, একটি দারোয়ানের চাকরি নিতে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। সে দেশের ব্যাংকগুলো এখনো সেকেলে কোটিপতির হিসাব প্রকাশ নিয়েই পড়ে রয়েছেন! ব্যাংকিং সেক্টরে দায়িত্বশীলদের এই সেকেলে চেতনা থেকে সরে এসে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা।
জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, বিশ্বব্যাপী ধনীদের এক সময়ে মিলিয়নার হিসাব করা হতো। এখন বিলিয়নার হিসাব করা হয়। আমাদের দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কোটিপতির হিসাব করছে। এটি এখন একটি দুর্বল সংখ্যা। এই হিসাব অবান্তর। এই হিসাবের কোনো যৌক্তিকতা নেই।
সূত্র মতে, বিশ্ব যেখানে বিত্তবানদের সম্পদ হিসাব করে মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন, কোয়াড্রিলিয়ন এবং কুইন্টিলিয়নে। আর বাংলাদেশের হিসাব এখনও লাখ, কোটি দিয়ে করা হয়। এটি ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি নামে পরিচিত। ভারতীয় এই সংখ্যা পদ্ধতি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় প্রচলিত আছে। যদিও ভারত ধীরে ধীরে এ সংখ্যা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসছে। তারাও এখন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধনীদের বিলিয়নার ও ট্রিলিয়নার হিসেবে প্রকাশ করছে। ধনীদের ক্ষেত্রে কোটিপতি শব্দের ব্যবহার ভারতেও অনেকটা উঠে গেছে। অথচ বাংলাদেশে হিসাবের ক্ষেত্রে হাজারের গণনা শেষ হলে লাখে চলে যায়। আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে হাজারের পর শুরু হয় মিলিয়ন। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আলোচিত ‘কোটিপতি’ শব্দটি শুনলেই বোঝা যায় কোটি টাকার হিসাব বা মালিক। বর্তমান আধুনিক যুগে দেশে কোটিপতিদের অভাব নেই।
যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে কোটিপতি শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকের প্রথম দিকে কোটিপতিদের দ্রুত বিকাশ শুরু হয়। তখন কোটিপতি শব্দটির মাধ্যমে দেশের নব্য ধনী শ্রেণিকে চিহ্নিত করা শুরু হয়। ওই সময় থেকেই দেশে জনপ্রিয়তা পায় ‘কোটিপতি’ শব্দটি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটিপতির হিসাবের তালিকায় অধিকাংশই প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। এ ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক। বাকি ১০ শতাংশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে কম করেও এক কোটি টাকা আছে তাদের নিয়েই হিসাব করা হচ্ছে এই সংখ্যা।
আর আশির দশকের কোটিপতি শব্দটিকে এখনও ব্যবহার করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে কোটি টাকার বেশি জমা ছিল, এমন হিসাবের সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচটি। ১৯৭৫ সালে ছিল ৪৭টি, ১৯৮০ সালে ৯৮টি হিসাব, ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে দুই হাজার ৫৯৪টি কোটিপতি হিসাব বা অ্যাকাউন্ট ছিল। এরপর ২০০১ সালে পাঁচ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে আট হাজার ৮৮৭টি ও ২০০৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১৬৩টি।
যদিও কাগজে-কলমে কোন অর্থবছর বা সাল থেকেই দেশে কোটিপতির হিসাব গণনা শুরু হয়েছে তার সঠিক কোনো সময় বলতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও তিন মাস পর পর এক কোটি টাকার আমানত জমা আছে এ রকম হিসাব সংখ্যা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মোট হিসাব সংখ্যা ১৬ কোটি ৯০ লাখ ২ হাজার ৬৭১টি। এর মধ্যে কোটি টাকার বেশি আমানত আছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা এক লাখ ২৮ হাজারের বেশি। কোটি টাকার বেশি স্থিতি থাকা এসব ব্যাংক হিসাবকেই কোটিপতি বলে উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক ধরে দেশে নীরবে বেসরকারি খাতে শিল্পবিল্পব ঘটে চলেছে। তিন হাজার থেকে বাড়তে বাড়তে প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার ও পরিমাণ বাড়ায় কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবও বাড়ছে। যদিও কোটি টাকার স্থিতি থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিলেও সে হিসাবগুলোর মধ্যে ব্যক্তির সংখ্যা কত, সে পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও নেই।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কোটিপতি হিসাবটি এখন হাস্যরসাত্মকে পরিণত হয়েছে। কারণ দেশের অনেক সাধারণ মানুষের কাছেও কোটি টাকা রয়েছে। তাই এখন আর কোটিপতি শব্দটি ব্যবহার যুক্তিযুক্ত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এখন বিভিন্ন বড় পদে রদবদলেও কয়েক কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়। সরকারি অফিসের ছোট একটি পিয়ন পদে চাকরি নিতেও অনেক ক্ষেত্রে ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ইনকিলাবকে বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো। এখন একটি ফ্ল্যাট ক্রয়ে এক কোটি থেকে মান ও স্থান ভেদে আড়াই কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। ‘কোটিপতি’ শব্দটির ব্যবহারে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তাই এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে বিলিয়নারদের তালিকা করে সেটি বিবেচনায় থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। গবেষক, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে যুক্ত হয়েছেন। তবে অধিকাংশের মতে কোটিপতি হিসাব সেকেলে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই হিসাবে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। অবশ্য কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যার ভিত্তিতে দাবি করা হচ্ছে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। যদিও এ বিষয়ে ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো, কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব আর কোটিপতির সংখ্যা কখনই এক নয়। এসব ব্যাংক হিসাবের গ্রাহকদের মধ্যে ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক ইনকিলাবকে বলেন, বিশ্ব ধনীদের চিহ্নিত করছে বিলিয়নার-ট্রিলিয়নার হিসেবে। আর আমরা এখনো সেই আশির দশকের কোটিপতি হিসেবেই পড়ে আছি। অর্থের হিসাবে ধনিক শ্রেণির মানদ-ের এই ধারা অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ইনকিলাবকে বলেন, কোটিপতি শব্দটির ব্যবহার যখন বাংলাদেশ ব্যাংক শুরু করে তখন দেশে এই সংখ্যা ছিল নগণ্য। ধীরে ধীরে দেশের বেসরকারি খাতে শিল্প বিপ্লব ঘটেছে। বর্তমানে দেশে প্রায় এক লাখ শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। তাই কোটিপতি শব্দ দিয়ে ধনিক শ্রেণির অর্থের হিসাব সেকেলে চিন্তা। এই শব্দটি যুগোপযোগী করা প্রয়োজন বলে মনে করেন আবুল কাশেম।