নারী ও কিশোরী পাচারে ৫৩টি রিক্রুটিং এজেন্সির সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে গত ১৩ জুলাই প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক কালবেলা। সেই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। এরপর তদন্তের স্বার্থে উল্লেখিত এজেন্সিগুলোকে চিঠি দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়। তবে গত ছয় মাসেও এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদনও। উল্টো গুরুতর এসব অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার কথা বলে এসব রিক্রুটিং এজেন্সি মালিককে ডেকে ডেকে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। যার তথ্যপ্রমাণ কালবেলার হাতে এসেছে।
এমনকি এই চাঁদাবাজির বিষয়টি সমন্বয়ের জন্য হোয়াটসঅ্যাপে খোলা হয় ‘কালবেলা-৫৩’ নামের একটি গ্রুপও। যে গ্রুপের চ্যাটিংয়ে টাকা তোলার রসিদও নিয়মিত শেয়ার করা হচ্ছে। এজেন্সি প্রতি চাঁদা ধার্য করা হয়েছে ১ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথমে দিতে হবে ৫০ হাজার, বাকি ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে পরে। চাঁদার এই টাকা ওঠাতে রাজধানীর আকরাম টাওয়ারে বসে গোপন বৈঠকও। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নারী-কিশোরী পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা ৫৩টি এজেন্সির মধ্যে ৩৫টির মালিক।
দৈনিক কালবেলায় গত ১৩ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল—বিদেশে উচ্চ বেতন আর উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে হাজার হাজার নারী কর্মীকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি মানসিক ও যৌন নির্যাতন করছে একটি অসাধু সিন্ডিকেট। সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। শ্রমিকদের প্রতারিত করে নিজেদের পকেটে ভরছে শত শত কোটি টাকা। অন্যদিকে, বিদেশে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন হাজারো বাংলাদেশি নারী। যাদের কেউবা ফিরে আসছেন নিঃস্ব হয়ে, কেউবা হারাচ্ছেন সম্ভ্রম, আবার কেউ কেউ পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি বা মানবিক আচরণ। বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কথা বিএমইটির। তবে খোদ বিএমইটিরই কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ওই অসাধু সিন্ডিকেটে সম্পৃক্ত থাকায় কঠোর নজরদারি কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না জড়িতদের। শুধু তাই নয়, এই সিন্ডিকেটভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জমা দেওয়া অনিয়মে ভরা ফাইল অনুমোদন হয়ে যায় দিনে দিনে, অথচ সব মানদণ্ড পূরণের পরও অন্যদেরটা পড়ে থাকে দিনের পর দিন। কালবেলার দীর্ঘ অনুসন্ধানে এই চক্রে অন্তত ৫৩টি রিক্রুটিং এজেন্সির জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে।
এরপর কালবেলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। কমিটি এজেন্সিগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিঠি পাঠায়। অন্যদিকে, বিএমইটির কয়েকজন কর্মকর্তা বিপুল টাকার বিনিময়ে তদন্ত প্রতিবেদন ইতিবাচক দিয়ে মন্ত্রণালয়কে ‘ম্যানেজ’ করার প্রস্তাব দেন এই এজেন্সিগুলোকে।
তথ্য বলছে, বিএমইটির ওই কর্মকর্তাদের পরামর্শ মোতাবেকই ৫৩টি এজেন্সি মিলে পুরো বিষয়টি সমন্বয়ের জন্য হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপ খোলে। প্রথমে গ্রুপটির নাম দেওয়া হয় ‘গ্রুপ কালবেলা-৫৩’। পরে গত ২০ অক্টোবর গ্রুপের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘কালবেলা-৫৩’। নাম পরিবর্তন করা হয়— ০১৭১৩০০৩৮** মোবাইল ফোন নম্বর থেকে। এ ছাড়া এই নম্বরটি থেকে একই ব্যক্তি ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তাদের গোপন বৈঠকের কিছু ছবি দিয়েছেন। যেখানে বিভিন্ন এজেন্সির মালিকদের বসে থাকতে দেখা গেছে। ২ হাজার ৮০০টির বেশি রিক্রুটিং লাইসেন্সের বিস্তারিত ঘেঁটে দেখা গেছে, ওই মোবাইল ফোন নম্বরটি এসএম ম্যানপাওয়ার ওভারসিজের মালিকের। এজেন্সিটির আরএল নম্বর: ১৩৭২। যেটি কালবেলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকা এজেন্সিগুলোর মধ্যে একটি।
‘কালবেলা-৫৩’ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই ছবিগুলোর আগের একটি বার্তায় দেখা যায়, যেখানে লেখা রয়েছে, ‘আমরা সবাই আকরাম টাওয়ারে চলে আসছি। আপনারা যত দ্রুত সম্ভব চলে আসেন, প্লিজ।’ এরপর নিজেদের অবস্থান জানান দিতে গ্রুপের কাউসার ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি ০১৮১১৬৫১০** মোবাইল ফোন নম্বর থেকে বৈঠকের আরও কিছু ছবি পাঠান। গ্রুপে ০১৮১৩৭০১৭** নম্বর থেকে লেখা হয় ‘ওকে’। একই ব্যক্তি একটু পর গ্রুপে লেখেন ‘তাড়াতাড়ি আসেন’। এজেন্সিগুলোর বিস্তারিত ঘেঁটে দেখা গেছে, ওই নম্বরটির মালিক বিপ্লব ইন্টারন্যাশনাল। এজেন্সিটির আরএল নম্বর-৩৩২।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটিতে অনেক বার্তা দেওয়া হয়েছে ০১৭৭৮৩১৯৬** নম্বর থেকে। এই মোবাইল ফোন নম্বরের সূত্র ধরে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ওই নম্বরটি এক ওভারসিজ মালিকের। তিনি কালবেলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকা ৫৩ এজেন্সির মধ্যে একটির মালিক। গত ২২ অক্টোবর এই ব্যক্তি গ্রুপে লিখেছেন, ‘সম্মানিত বায়রার সদস্যবৃন্দ আসসালামু আলাইকুম। আমাদের কথা অনুযায়ী অনেকে এখনো যোগাযোগ করেন নাই। আমাদের যথাসময়ে এই কাজটা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা উচিত। সবাই গ্রুপে একটু যোগাযোগ করেন, প্লিজ।’ একই দিন ০১৭১৫৫৪৭২** নম্বর থেকে দেওয়া আরেকটি বার্তায় লেখা হয়, ‘আসসালামু আলাইকুম, সম্মানিত রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকবৃন্দ, আমাদের সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মঙ্গলবার ও বুধবারের মধ্যে ধার্যকৃত টাকা জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, আপনারা আজকের মধ্যে টাকা জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’
চাঁদার এই টাকা উঠাতে এজেন্সিগুলোর তালিকা তৈরি করে বানানো হয় এক্সেল শিট। টাকা জমা দেওয়ার পরে সেই শিটে নাম ও এজেন্সির পাশে ৫০ হাজার টাকা লিখে দেওয়া হয় গ্রুপে। গ্রুপটিতে এমন বেশ কিছু শিট দেওয়া হয়েছে, যেগুলো কালবেলার হাতে এসেছে। গ্রুপে গত ২৩ অক্টোবর একটি শিট শেয়ার করে একজন লিখেছেন, ‘আল-মিনার, আক্তার ভাই, রিসিভড (অর্থাৎ টাকা বুঝে পেয়েছেন); গলফ ইন্টারন্যাশনাল, রিসিভড; ইজিওয়ে, টাকা রিসিভড; তাসনিম ওভারসিজ, আরএল নম্বর : ৫৬৮, টাকা পেইড; ফ্যালকন ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা, টাকা পেইড; টিপিএস-৩৬০- টাকা পেইড; ইফতি ওভারসিজ, টাকা পেইড; ইফতি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, টাকা পেইড; আল-মাহমুদ ওভারসিজ, টাকা পেইড; প্রসেড ওভারসিজ, আরএল নম্বর : ১২০৪, টাকা পেইড।’
গ্রুপে ০১৯৬৭৯২৭১** নম্বর থেকে ২৩ অক্টোবর এক ব্যক্তি লেখেন, ‘টাকা দিতে চাচ্ছি, ভাই ফোন রিসিভ করেন।’ উত্তর দিয়ে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তি লেখেন, ‘ভাই আসসালামু আলাইকুম, আমি অফিসে আছি, কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে এসে ফোন দেন প্লিজ।’ ২৪ অক্টোবর ০১৮১৫৪৫১৪** নম্বর থেকে এক ব্যক্তি লেখেন, ‘মিটিংয়ে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাই তো এখনো টাকা জমা দেন নাই, আর যারা উপস্থিত ছিলেন না তাদেরকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হোক।’ উত্তরে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তি লেখেন, ‘সবাই বাকি, মাত্র ৮ জন দিয়েছে।’
২৯ অক্টোবর নেতৃত্ব দেওয়া ওই ব্যক্তি লেখেন, ‘৫৩ কালবেলা সমস্যা, লাইসেন্স এর সম্মানিত মালিকদের অনুরোধ করছি অনেকে এখনো টাকা দেন নাই। সবাইকে উক্ত সম্মানিত লাইসেন্সের মালিকদের নিকট টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। এরপর নিচে কয়েকজনের নাম দেওয়া হয়। তারা হলেন—ইফতি ওভারসিজের মালিক মো. রুবেল, আল-মিনার ওভারসিজের আক্তার হোসেন, মক্কা ওভারসিজের মালিক জামাল হোসেন ও ইজিওয়ে ইন্টারন্যাশনালের মালিক মনির হোসেন।’
৩০ অক্টোবর আরও কিছু শিট গ্রুপে দিয়ে লেখা হয়—‘১৮ জন এজেন্সির মালিক টাকা জমা দিয়েছেন।’ প্রতিউত্তরে ০১৮১৩৭০১৭** নম্বর থেকে লিখা হয়, ‘সবাই এই ঝামেলা তাড়াতাড়ি শেষ করেন।’ নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তি তখন লিখেন, ‘সকল এজেন্সির মালিক টাকা দেন নাই।’ এমন আলাপনের এক পর্যায়ে ০১৯৬৭৯২৭১** নম্বর থেকে লেখা হয়, ‘৩৫ জন উপস্থিত ছিলাম (গোপন মিটিংয়ে) সবাই তো স্বেচ্ছায় টাকা দিতে চাইছিল।’ উত্তরে আল-মিনারের আক্তার হোসেন লেখেন, ‘৫১ জনের মধ্যে শুধুমাত্র ১৮ জন টাকা প্রদান করেছেন। তার মানে হলো—বাকিরা সম্মিলিতভাবে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী না অথবা তাদের ধারণা যারা টাকা প্রদান করেছেন তাদের সমস্যা সমাধান হয়ে গেলে বাকিদেরও সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে আমার অভিমত হলো, একটা সময় নির্ধারণ করে দেওয়া, এর মধ্যে যদি সবাই টাকা প্রদান করে সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে না আসেন তাহলে ধরে নিতে হবে উনারা সবাই তাদের নিজের সমস্যা নিজেরা সমাধানে আগ্রহী। এই ক্ষেত্রে যারা টাকা প্রদান করেছেন শুধু এই ১৮ জনের সমস্যা সম্মিলিতভাবে সমাধান করার চেষ্টা করা। কিন্তু যারা টাকা প্রদান করেন নাই তাদেরকে বাদে আর যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে তাদের প্রত্যেকের টাকা ফেরত প্রদান করা... ১৮ জনের বাহিরে যারা আছেন তারা যদি নিজের উদ্যোগে যার যার সমস্যা সমাধান করতে পারেন তাহলে আশা করি এই ১৮ জনও তাদের নিজের উদ্যোগে যার যার নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারবে।’ এর প্রতিউত্তরে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তি বলেন, ‘রুবেল আজ কি আমরা কোথাও বসতে পারি, জানাও প্লিজ।’ আরেকটি বার্তায় লিখেছেন, ‘আক্তার ভাই, জামাল, মনির, আল-আমিন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সবাই মতামত দেন।’
একই গ্রুপের ০১৯৬৭৯২৭১** নম্বর থেকে একজন বলেন, ‘আরও অনেক লাইসেন্স বন্ধ হবে। ভাই আপনারা বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখেন, যারা টাকা দেবে না তাদের বাদ দেন। যেই ১৮ জন আছে, দরকার হলে আরও টাকা নিয়ে এই ঝামেলাটা শেষ করেন।’
এ ছাড়া গ্রুপে আরও বেশ কয়েকজন এজেন্সি মালিক একাধিক বার্তা দিয়েছেন, যা কালবেলার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব বার্তার ফোন নম্বর থেকে বায়রার ২৮০৭টি রিক্রুটিং লাইসেন্সের বিস্তারিত ঘেঁটে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটির আলাপনে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন এমন বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে কালবেলা। যারা সবাই কিশোরী-নারী পাচারে নাম আসা ৫৩টি এজেন্সির মধ্যে রয়েছে। এগুলোর লাইসেন্স নম্বরগুলো হলো—আল মিনার ওভারসিজ-আরএল; ১২৩৫; বিপ্লব ইন্টারন্যাশনাল, আরএল নম্বর: ৩৩২; এসএম ম্যানপাওয়ার, আরএল নম্বর : ১৩৭২, মাহি বিজনেস, আরএল নম্বর : ৮০২, নুসাইবা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আরএল নম্বর : ১৬১২, গলফ ইন্টারন্যাশনাল, আএল নম্বর : ১২২১; সান ওভারসিজ, আরএল নম্বর : ৭৫৯।
সংশ্লিষ্ট সূত্র কালবেলাকে জানিয়েছে, বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আব্দুল হাই এবং আরও কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা এসবের পেছনে রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট এজেন্সির মালিকরা বলছেন, প্রতি এজেন্সিকে ১ লাখ টাকা করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ হাজার টাকা আগে এবং ৫০ হাজার টাকা পরে দিতে হবে। প্রথম ৫০ হাজার টাকায় তারা বিএমইটির তদন্ত প্রতিবেদন ভালো (ইতিবাচক) দেবে। এরপর সেই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠালে দিতে হবে আরও ৫০ হাজার টাকা। সেই টাকায় মন্ত্রণালয় থেকে সব অভিযুক্ত এজেন্সিকে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে।
এমন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল হাই গালি (সংবাদপত্রে প্রকাশের অযোগ্য ভাষা) দিয়ে বলেন, ‘যে অভিযোগ করেছে তাকে নিয়ে আসেন। তারপর আপনি স্বয়ং তার বিচার করবেন। আপনার সাহসী ভূমিকাকে অবশ্যই জনগণ সম্মান করবে।’
জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট অনুবিভাগ) এ জেড এম নুরুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘কেউ দুর্নীতি করলে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি আমাদের নজর আসেনি, আপনি বললেন, আমরা খতিয়ে দেখব। আপনার কাছে প্রমাণ থাকলে আমাদের দেন, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরকে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে তার কার্যালয়ে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে রিক্রুটিং এজেন্সি আল মিনারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের চিঠি দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছে। তাই আমরা সামগ্রিক বিষয়ে আলোচনা করেছি গ্রুপে, কীভাবে এটা সমাধান করা যায়, তা নিয়ে।’ টাকার বিষয়ে এই এজেন্সি মালিক বলেন, ‘সামগ্রিক যদি খরচ-টরচ লাগে; সেজন্যই তোলা আরকি।’
মাহি বিজনেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সবুজ মিয়া কালবেলাকে বলেন, ‘আমি তো টাকা দিইনি এবং আমি ওই গ্রুপটি আর্কাইভ করে রেখেছি। মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে যেসব তথ্যপ্রমাণ চেয়েছে, আমি সব তথ্যপ্রমাণ দিয়ে এসেছি। আমি বলেছি, আমি কোনো টাকা-পয়সা দেব না। কারণ, আমার সব কাগজপত্র ঠিক আছে, আমার কোনো যাত্রী বিদেশে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়েনি।’
জানতে চাইলে বিপ্লব ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দীন বলেন, ‘আমি গ্রুপে (আলোচিত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ) আছি। তারা যা বলে শুনি, দেখি। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।’
এদিকে মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধে জড়ানো এজেন্সি মালিকদের পাশাপাশি টাকার বিনিময়ে তাদের রক্ষার চেষ্টা করা বিএমইটি কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহির আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তাগিদ দিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এমন অনিয়ম, এটি কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। এটি দুর্নীতির এক অভিনব রূপ।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘মানব পাচার একটি গুরুতর অপরাধ, আর এ অপরাধে জড়িতদের ১ লাখ টাকার বিনিময়ে সুরক্ষা দেওয়া—এটা সরকারের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক। একই সঙ্গে যারা এ মানব পাচার চক্রকে রক্ষা করেছে বা সহযোগিতা করেছে, তারা নিজেরাও অপরাধে জড়িত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, মহাপরিচালক বা অতিরিক্ত মহাপরিচালক যে পর্যায়েরই হোক, এ ঘটনায় তারা দায়মুক্ত হতে পারে না। এটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের দায়িত্ব ছিল দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ আপস রফা আসলে দুর্নীতি, মানব পাচার এবং অর্থ পাচারের এক ন্যক্কারজনক উদাহরণ।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান তিনটি জরুরি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘প্রথমত ৫৩টি প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ (ফ্রিজ) করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব এজেন্সিকে আইনের আওতায় এনে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে। আপস রফায় যারা জড়িত—অফিসার, কর্মকর্তা বা অন্য যেই হোক—তাদের প্রত্যেককে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কারণ, এটি শুধু দুর্নীতি নয়; মানব পাচারকে প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধেও তারা দায়ী।’