রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মারধরের শিকার ও গ্রেফতার হওয়া রিকশাচালক মো. আজিজুর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে পুলিশ। পুরোনো একটি মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে গ্রেফতার দেখানো হলেও শেষ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাননি তদন্ত কর্মকর্তা।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩(এ) ধারায় গত ২৬ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অন্তর্বর্তী বা অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এরই মধ্যে প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেছেন আদালত।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩(এ) ধারা মূলত অন্তর্বর্তী বা অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের বিধান। কোনো মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করা না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আদালতে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এতে এখন পর্যন্ত কী পাওয়া গেছে, প্রাথমিক অভিযোগ টিকে আছে কি না এবং তদন্ত শেষ হতে কেন সময় লাগছে—এসব বিষয় উল্লেখ থাকে।
‘এই ধারার অধীনে আদালত চাইলে কাউকে আপাতত অব্যাহতি দিতে পারেন, কারণ এটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন নয়। তদন্তে নতুন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে আবার তাকে আসামি হিসেবে যুক্ত করার সুযোগও থাকে।’ - সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী
মামলার ১৭৩(এ) ধারার ব্যাখ্যা জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই ধারার অধীনে আদালত চাইলে কাউকে আপাতত অব্যাহতি দিতে পারেন, কারণ এটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন নয়। তদন্তে নতুন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে আবার তাকে আসামি হিসেবে যুক্ত করার সুযোগও থাকে। তাই ১৭৩(এ) ধারা মূলত তদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও আদালতকে তদন্তের অগ্রগতি অবহিত রাখার একটি প্রক্রিয়া।’
পুলিশের প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে
ধানমন্ডি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তৌহিদুর রহমান গত ১৬ আগস্ট আজিজুর রহমানকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জেনিফার জেরিনের আদালতে পাঠান। আদালত তা মঞ্জুর করে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
আদালতে দাখিল করা পুলিশ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ১৫ আগস্ট বিশেষ দিনে ধানমন্ডি মডেল থানার ৩২ নম্বর রোড সংলগ্ন মিরপুর রোড এলাকায় ফুল দিতে গেলে স্থানীয় জনগণের রোষানলে পড়ে গণপিটুনির শিকার হন আজিজুর রহমান। পরে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে উত্তেজিত জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে থানায় নেয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা ও গোপন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে ধারণা করা হয়, আজিজুর রহমান আগের একটি অস্ত্র মামলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। থানায় নেওয়ার পর তার আচরণ ‘সাধারণ রিকশাচালকের মতো মনে হয়নি’ এবং ‘নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য বা তাদের সোর্স’ হতে পারেন, এমন সন্দেহ পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
পুলিশের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আজিজুরের ফুলের তোড়ায় লেখা ছিল: ‘১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবেসে সাধারণ রিকশাওয়ালা হিসেবে সৎ উপার্জনের টাকা দিয়ে ফুল কিনেছি। আমি কোনো দল করি না, শুধু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি।’ এই লেখাও সন্দেহ উস্কে দিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ যাচাই-বাছাই ও বিস্তৃত তদন্তের পর আজিজুরের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনায় সুনির্দিষ্ট বা নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে তাকে আপাতত ১৭৩(এ) ধারায় অব্যাহতির সুপারিশ করেছে পুলিশ। তবে ভবিষ্যতে প্রমাণ মিললে তাকে অভিযুক্ত করা হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
যে মামলায় জড়িত দেখানো হয় আজিজুরকে
আজিজুরকে যেই মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, সেটি ধানমন্ডি থানার একটি নিয়মিত মামলা। এফআইআর নম্বর ৩, তারিখ ২ এপ্রিল ২০২৫, জিআর নম্বর ৮৮।
অভিযোগে দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হত্যাচেষ্টা, গুলিবর্ষণ, হামলা, অগ্নিবোমা নিক্ষেপসহ বিভিন্ন অপরাধের কথা বলা হয়েছে।
এজাহারে অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আন্দোলন দমনে পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দলীয় নেতাকর্মীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ও নির্যাতন চালায়, যেন হাজারো মানুষ আহত এবং আনুমানিক দুই হাজার মানুষ নিহত হন।
মামলায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট নিউমার্কেট থেকে সায়েন্সল্যাবমুখী মিছিলে গুলিবর্ষণের সময় এই মামলার বাদী পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। থানা মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তিনি আদালতের আশ্রয় নেন, আদালত তা এজাহার হিসেবে গণ্য করে ধানমন্ডি থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেন। মামলায় ধারা যোগ করা হয়েছে-১৪৩/১৪৭/১৪৯/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩৪ পেনাল কোড, ১৮৬০।
১৪৩, ১৪৭ ও ১৪৯ ধারা বেআইনি সমাবেশ ও দাঙ্গার অভিযোগ নির্দেশ করে। আর ৩২৫, ৩২৬ ও ৩০৭ ধারায় গুরুতর আঘাত ও হত্যাচেষ্টার মতো অপরাধ অন্তর্ভুক্ত। ৩৪ ধারা সম্মিলিত অপরাধের দায় নির্ধারণ করে, যেখানে একাধিক ব্যক্তি মিলিতভাবে ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে বিবেচিত হন।
আজিজুরের জামিন ও আদালতের আগের আদেশ
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গত ১৭ আগস্ট রিকশাচালক আজিজুর রহমানকে জামিন দেন। তার আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন তখন জাগো নিউজকে বলেছিলেন, পুরোনো হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলেও আদালত ১ হাজার টাকার মুচলেকায় জামিন মঞ্জুর করেন।
১৫ আগস্টের ঘটনার বিবরণ
১৫ আগস্ট দুপুর সোয়া ১২টায় আজিজুর রহমান বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে ফুল দিতে যান। নিজেকে রিকশাচালক পরিচয় দিয়ে তিনি জানান, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেই এসেছেন। এ সময় কয়েকজন তাকে মারধর করলে পুলিশ তাকে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
আজিজুর রহমানকে হত্যা মামলার আসামি হিসেবে নয়, বরং একটি নিয়মিত মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আদালতে পাঠানো হয়েছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তাকে হত্যামামলার আসামি হিসেবে প্রচার ‘মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক’। ডিএমপি ও অন্তর্বর্তী সরকার
ডিএমপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের পৃথক ব্যাখ্যা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তখন জানায়, আজিজুর রহমানকে হত্যা মামলার আসামি হিসেবে নয়, বরং একটি নিয়মিত মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আদালতে পাঠানো হয়েছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তাকে হত্যা মামলার আসামি হিসেবে প্রচার ‘মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক’ বলে মন্তব্য করে।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিবৃতিতে ধানমন্ডি থানার ওসির কাছে ব্যাখ্যা তলব করে জানতে চায়-কী কারণে একজন রিকশাচালককে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হলো। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার আচরণে কোনো অসঙ্গতি আছে কি না তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়।
সে সময় অন্তর্বর্তী সরকার মামলায় আজিজুর রহমানের সম্পৃক্ততা দ্রুত যাচাইয়ের অংশ হিসেবে সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধি-সিআরপিসির ১৭৩(এ) ধারায় অতিসত্বর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ওই নির্দেশ অনুসারেই প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা।