২১ শে নভেম্বরের ভূমিকম্প বাংলাদেশকে ভয়াবহভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। এটি ছিল ভূমিকম্প সতর্ক সংকেত। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় কি ঘটতে পারে সে বিষয়ে প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ। অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত ‘দ্র লেটেস্ট আর্থকোয়েক ওয়াজ এ ওয়ার্নিং সাইন: বাংলাদেশ ইজন্ট রেডি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে নিবন্ধিত ভূতাত্ত্বিক ও বহু গবেষণার লেখক থমাস এল ডেভিস, পিএইচডি। তিনি লিখেছেন, ২১ নভেম্বর একটি ভূমিকম্প বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়। এর মাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে কম- রিখটার স্কেলে ৫.৫। তবুও এটি দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। কারণ ২রা ডিসেম্বর ভোরে আরেকটি হালকা ভূমিকম্পও অনুভূত হয়েছে।
একদিকে, ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণত সক্রিয় ভূকম্পন অঞ্চলের পশ্চিম ও দক্ষিণের দিকে। বিষয়টি ভূতাত্ত্বিকদের বিস্মিত করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, পুরনো বেইসমেন্ট ফল্ট পুনরায় সক্রিয় হয়ে সৃষ্ট হয়েছে এই ভূমিকম্প। এ ধরনের ভূমিকম্প সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান খুব সীমিত। পুনরাবৃত্তির সময়কাল বা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রা- কোনোটিই নিশ্চিতভাবে জানা নেই। ফলে এই ঘটনার মাধ্যমে ঢাকার প্রান্তসীমায় অবমূল্যায়িত একটি ভূমিকম্প ঝুঁকি সামনে এসেছে। ২১শে নভেম্বরের ভূমিকম্পটির মাত্রা মাঝারি হলেও এতে ১০ জনের মৃত্যু, ৬ শতাধিক মানুষ আহত এবং বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধসে পড়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ হিসাব এখনও সম্পন্ন হয়নি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এর উপকেন্দ্র ঢাকার কেন্দ্র থেকে মাত্র ২৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে।
উচ্চ জনঘনত্ব ও ভঙ্গুর নগর কাঠামোর শহরগুলো, বিশেষ করে ঢাকা, যার জনসংখ্যা ৩ কোটি ৬৬ লাখ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩,০০০ থেকে ৩০,০০০ মানুষ বসবাস করে, এই শহর মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ঢাকাকেন্দ্রিক একটি বড় ভূমিকম্প বা আরও শক্তিশালী কোনো ঝাঁকুনি প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ঢাকা এবং সারাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা আছে এবং সরকার ঝুঁকি কমাতে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। তবে বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক সীমাবদ্ধতা বড় বাধা।
তবু সবচেয়ে কার্যকর অনেক পদক্ষেপই হলো নিয়ন্ত্রক ও প্রাতিষ্ঠানিক- তার বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক সহায়তায় করা সম্ভব, অর্থাৎ দেশীয় অর্থ ব্যয় খুবই সামান্য। এখনই বাংলাদেশ কম খরচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো-
১. নতুন ভবনের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি ২০২০) ইতিমধ্যে ভূমিকম্প সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়। নতুন কোনো নিয়ম লাগবে না। এক্ষেত্রে মূল বিষয় হলো বাস্তবায়ন। বাংলাদেশকে অবশ্যই শতভাগ বিএনবিসি অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে ভবন অনুমোদন, ইউটিলিটি সংযোগ, ব্যাংক ঋণ প্রদান এবং সমাপ্তি সনদের ক্ষেত্রে।
২. ঝুঁকিপূর্ণ পুরোনো ভবনগুলোতে অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা
রাজউকের মতো সাম্প্রতিক জরিপে এমন বহু ভবন চিহ্নিত হয়েছে যেগুলো ধ্বংস, খালি করা বা সংস্কারের প্রয়োজন। যেসব স্থাপনায় অগ্রাধিকার দিতে হবে তার মধ্যে আছে স্কুল, হাসপাতাল, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন, জরুরি সেবা (ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সামরিক স্থাপনা), বড় কারখানা। বাংলাদেশকে কম খরচে ভবনসংস্কারের প্রচার করতে হবে, জাতীয়ভাবে কম-খরচে রেট্রোফিট নির্দেশিকা প্রকাশ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও দাতা-সহায়ক প্রকৌশল দল গঠন করতে হবে এবং দুইতলা বা তার বেশি ভবনের জন্য সহজ একটি ভূমিকম্প-নিরাপত্তা চেকলিস্ট চালু করতে হবে। এটি শুধু নিরাপত্তাই বৃদ্ধি করবে না- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে।
৩. কম খরচের জনসচেতনতা ও প্রস্তুতি কর্মসূচি চালু করা
বাংলাদেশ কম ব্যয়ে নিম্নলিখিত প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে- জাতীয় ভূমিকম্প মহড়া দিবস (স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, কারখানা, সরকারি দপ্তরসহ)। এসএমএসভিত্তিক সতর্কতা ও নিরাপত্তা বার্তা। স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্র ও ওপেন স্পেস সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি। বিদ্যমান দুর্যোগ সেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও প্রশিক্ষণ।
৪. আন্তর্জাতিক দাতাদের সঙ্গে সমন্বয় বৃদ্ধি
বাংলাদেশকে বৈশ্বিক সহায়তা সংস্থাগুলোর কাছে ভূমিকম্প ঝুঁকি, ক্ষতি এবং উপরোক্ত কমখরচের প্রশমন কৌশল তুলে ধরতে হবে। এতে দেশীয় খরচ কম এবং প্রভাব বেশি হবে। বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপিআর, এডিবি, জাইকা এবং অন্যান্য সংস্থা ইতিমধ্যে দুর্যোগ প্রস্তুতি ও স্থিতিস্থাপকতা প্রকল্পে বিনিয়োগ করে থাকে।