বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের বন্ধ থাকা ১৬ কোম্পানির মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত ১১টি কারখানা ‘মানবিক কারণে’ সচল করতে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা।
বেক্সিমকো গ্রুপের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক সৈয়দ মো. এনাম উল্লাহ বলেছেন, “আমরা শ্রমিক-অফিসাররা পেটের দায়ে আপনাদের কছে এসেছি। সরকারের কাছে অনুনয়, বিনয় করে বলতে চাই, সরকার বেক্সিমকোতে হস্তক্ষেপ করুক। কারখানা খুলে দিয়ে আমাদের চাকরি বাঁচান।’’
এই দাবি নিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার পল্টনে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরামের (সিএমজেএফ) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন বেক্সিমকো গ্রুপের একদল কর্মী। তাদের ভাষ্য, মালিকপক্ষকে জানিয়েই তারা সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন।
এনাম উল্লাহ বলেন, “সরকার যেভাবে চাইবে, প্রতিষ্ঠান সেভাবে চালাক। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিক। কারখানা চালু থাকলে ধীরে ধীরে সবার পাওনা দিতে পারবে।’’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনটি দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হল– অবিলম্বে লে-অফ প্রত্যাহার করে বেক্সিমকোর পোশাক খাতের সব কারখানা খুলে দেওয়া, রপ্তানি বাণিজ্যর জন্য পোশাকের ক্রয়াদেশ পেতে ব্যাংকের ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলার অনুমতি এবং ব্যবসা চলমান রেখে সকল বকেয়া বেতন, কোম্পানির দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়া।
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থ্যানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোতে অস্থিরতা চলছে। শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে বন্ধ রাখা হয়েছে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের অধিকাংশ কারখানা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ গ্রুপের তিন কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও শাইনপুকুর সিরামিকসই কেবল সরকারের হস্তক্ষেপে সচল রয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও উপদেষ্টা। তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে গ্রুপটির বেশিরভাগ উদ্যোক্তা আত্মগোপনে রয়েছেন।
অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ থাকায় এলসি খুলতে পারছে না কোম্পানি। ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া বন্ধ হওয়ায় নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলো।
বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে মোট ১৬টি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের। এই ১১টি কারখানা সচল করার দাবি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন কর্মীরা।
সৈয়দ মো. এনাম উল্লাহ বলেন, “লে-অফ সুবিধা ১৬ কোম্পানির ২৭ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী পাচ্ছেন। তারা অর্ধেক বেতন পাচ্ছেন এখন।
“এসব কোম্পানিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করা শ্রমিক-কর্মচারীদের সংখ্যা ২৭ হাজার। এক বছরের নিচে থাকা কর্মচারী-কর্মকর্তা মিলিয়ে তা ৪২ হাজারর মত।”
সরকার রিসিভার (প্রশাসক) নিয়োগ দেওয়ার পর থেকে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কর্মচারী-শ্রমিকদের বেতন বকেয়া নেই বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
কোম্পানি সচল করতে উদ্যোক্তাদের বদলে শ্রমিক প্রতিনিধিরা কেন আন্দোলনে নেমেছেন– এ প্রশ্নের উত্তরে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল কাউয়ুম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা তো মালিকপক্ষের একজনকে চিনি, তিনি বেক্সিমকোর এমডি ওসমান কায়সার। তার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে সব মালিকদের।
“মালিক পক্ষ সারেন্ডার করে বসে আছে। তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাচ্ছি না। এজন্য রাস্তায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি।’’
সালমান এফ রহমান এবং তার ভাই সোহেল এফ রহমান দুজনই বেক্সিমকো চালিয়ে এসেছেন মন্তব্য করে আব্দুল কাউয়ুম বলেন, “সোহেল এফ রহমানও বিদেশে। তারা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কিন্তু এখনো কারখানা খোলা হয়নি। আগামী ৩১ জানুয়ারির পর কি হবে, কেউ বলছে না। সরকারও না, মালিকরাও না।’’
আন্দোলন আর সংবাদ সম্মেলন করতে মালিক পক্ষই শ্রমিকদের পাঠিয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে এনাম উল্লাহ বলেন, “আমরা শ্রমিকরা পেটের দায়ে সরকারের কাছে আবেদন করছি। সংবাদ সম্মেলনে আসার বিষয়টি মালিকপক্ষকে জানিয়েই এসেছি, তার জানে।’’
সংবাদ সম্মেলনে আব্দুল কাউয়ুম বলেন, “আমরা তো মালিকপক্ষের কোনো অনিয়মের কথা জানতাম না। সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তারের পর মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের কথা শুনেছি। এখন একজনের ভুলের জন্য তো সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে না। সরকার দায়িত্ব নিক, কারখানা খুলে দিক, ব্যাংক ঋণ দিয়ে এলসি করার সুযোগ দিক।’’
বেক্সিমকোতে রিসিভার বসানোর পর সম্পদের একটি হিসাব করা হয়েছে জানিয়ে কাউয়ুম বলেন, “কারখানা, মেশিন, জমিসহ বর্তমানে সব সম্পদ বিক্রি করলে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে। অথচ শ্রমিক-কর্মচারীদের বিদায় দিতেই লাগবে ২২ হাজার কোটি টাকা। সেজন্য কোম্পানি বন্ধ করা বা বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করা সম্ভব না।”
কোম্পানিগুলোর প্রতি মাসে বেতন, জ্বালানি বিল, বিদ্যুৎসহ ১০০ কোটি টাকা পরিচালন খরচের হিসাব দিয়ে কাউয়ুম বলেন, “সরকার যদি সুযোগ দেয়, তাহলে পরিচালন খরচের পর সব টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করুক।’’
ব্যাংকগুলো এলসি সুবিধা ও চার মাসের জন্য আর্থিক সুবিধা দিলে বেক্সিমকোর সব কোম্পানি সচল করা সম্ভব বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়।
আব্দুল কাউয়ুমের হিসাবে, কারখানা খুলে দেওয়ার পর পরিচালন খরচ বাদ দিলে প্রতি বছর সাড়ে ৪০০ কোাটি টাকার ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব।
সৈয়দ এনাম উল্লাহ বলেন, “এখন তো টাকা নেওয়ার কেউ নেই। পাচার করার সুযোগও থাকবে না। রিসিভার আছে, তার অনুমতি ছাড়া কোনো টাকা এদিক সেদিক হবে না। সরকারতো সব হিসাব দেখতে পারবে।’’
তিনি বলেন, “আগে তো এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তখন আয়ের অংশ কোথায় নিচ্ছি, এটা সরকার জানত না, আমরাও জানতাম না। এখন কিন্তু একটা রিসিভার আছে। এখন এক টাকা অর্ডারেরও হিসাব সরকার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাখতে পারবে।”
সংবাদ সম্মেলনে আব্দুল কাউয়ুম বলেন, “মালিকপক্ষ এখন পর্যন্ত ১৫-২০টি প্রস্তাব সরকারের কাছে দিয়েছে। তারা দুই পা এগোলেও সরকার আগাচ্ছে না।”
সরকার ও বেক্সিমকোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা হন ২০০৯ সালে।
২০১৯ সালে তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়। গত দুটি নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সালমান দেশের ব্যবসায়ী মহলেও ছিলেন প্রতাপশালী একজন।
নিজের ভাই আহমেদ সোহেল এফ রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সালমান ১৯৭২ সালে গঠন করেন বেক্সিমকো (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড), যা পরে গ্রুপ হিসেবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে বিভিন্ন খাতে।
ওষুধ, বস্ত্র, আমদানি-রপ্তানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হোটেল, প্রকৌশল, মিডিয়াসহ নানা খাতে ছড়িয়ে আছে বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যবসা।
সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তার সংশ্লিষ্ট সকল ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করে। বেক্সিমকো গ্রুপকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া জনতা ব্যাংকও অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়।
তাতেই বেক্সিমকো গ্রুপের তৈরি পোশাক খাতের সব কারখানার কাঁচামাল আমদানির সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।েএক পর্যায়ে লে অফ ঘোষণা করা হয় ১৬ কোম্পানি।
এ অবস্থায় বেতন না পেয়ে বেক্সিমকোর বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করলে সরকার তিন মাসের বেতনের ব্যবস্থা করে দেয়। পরে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক, কর্মচারীর কর্মসংস্থান ঠিক রাখা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও অর্থনীতির স্বার্থে কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে সরকারের উপদেষ্টা পর্যায় থেকে একটি কমিটি করা হয়।
সেই কমিটি বেক্সিমকোর কোম্পানিগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করে সিদ্ধান্ত নেয়। মুনাফায় থাকা কোম্পানিগুলো চালানোর পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয় উপদেষ্টা কমিটি। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১ জানুয়ারি তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানিতে ২৫ জন করে স্বতন্ত্র পরিচালক বসায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
তবে বেক্সিমকো গ্রুপের অন্য কারখানাগুলোর বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ উপদেষ্টা কমিটি থেকে নেওয়া হয়নি।