Image description

এ যেন ঘোড়ার আগেই লাগাম কেনা। চাহিদা না বাড়লেও একের পর এক গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন না করেও ব্যবসায়ীরা পেয়ে গেছেন টাকা। জনগণের টাকার এমন শ্রাদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে। এ সময়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এতেই শেষ নয়; অসম চুক্তি, ভুল নীতি ও অনিয়মের কারণে আরও দুই যুগের বেশি সময় দেশবাসীকে টানতে হবে ঘানি।

 

মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। শক্ত হাতে লাগাম টানতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কমিটি ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিলের সুপারিশ করতে পারে বলে জানা গেছে।

 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় ৯১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই। গত বছর এমন ৪১ শতাংশ কেন্দ্র খামোখা বসে ছিল। এসব কোম্পানির সঙ্গে সরকারের চুক্তিতে শর্তই ছিল বিদ্যুৎ না কিনলেও তারা ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ পাবে। গত বছর এ চার্জ বাবদ সরকারি ব্যয় ছিল ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে ছিল প্রায় ১১ শতাংশ সিস্টেম লস। ১ শতাংশ সিস্টেম লসের জন্য জনগণকে গুনতে হয় ৭০০ কোটি টাকা। অঙ্কের হিসাবে ১১ ভাগ সিস্টেম লসে গেছে ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সব মিলে বছরে ৩৩ হাজার কোটি টাকা সরকার বিনা কারণে খরচ করে।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পর্যালোচনা কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, আমাদের মূল টার্গেট থাকবে ক্যাপাসিটি চার্জের দিকে। বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রই ১৫ বছরে বিনিয়োগের অনেক বেশি আয় করেছে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে। এবার এ খাতে লাগাম টানতে হবে। অভিযোগ উঠেছে, শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হাতিয়ে নিতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের কল্পিত চাহিদা দেখিয়ে মূলত লুটপাটের উদ্দেশ্যেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তৈরি করা হয়েছে। যে কারণে এ মুহূর্তে চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯০ মেগাওয়াট। দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের চাহিদা থাকে গরমে এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে। বিদ্যুৎ বিভাগ গত বছর গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা ধরেছিল ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। আগামী গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা যদি ১৮ হাজার মেগাওয়াট ধরা হয়, তাতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার চেয়ে ৯ হাজার ৭৯০ মেগাওয়াট বেশি থাকবে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি হবে। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের বিবেচনায় চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা বেশি থাকতে হয়।

 

পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। যদিও এ সময় বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। কিছু কিছু কেন্দ্র বছরে সক্ষমতার ২-৩ শতাংশ উৎপাদন করেছে। অথচ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হবে-এমন শর্তেই চুক্তির সময় ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়।

 

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্রয়চুক্তির ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিলের সুপারিশ করা হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের লাভ উঠে গেছে। এখন হয় তাদের চুক্তি বাতিল করতে হবে, নতুবা ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল করতে হবে।

 

পিডিবির তথ্যমতে, ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। বর্তমানে গ্রুপটির ১ হাজার ৯৮১ মেগাওয়াটের আটটি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনছে পিডিবি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠদের এই ব্যবসায়ী গ্রুপ গত দেড় দশকে শুধু বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে আয় করেছে ১৪ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। দেশি এ ধরনের আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে শত শত কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে পকেটে তুলেছে। একইভাবে বিদেশি কোম্পানিও টাকা নিয়ে গেছে।

 

ভারতের আদানি গ্রুপ দেড় বছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ৫ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা তিন বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১২ হাজার ৪২ কোটি টাকা। চালুর পর বেশির ভাগ সময় বসে থাকা বাঁশখালীর এস আলম কেন্দ্রটি এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ৩ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ১ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে।

 

এ প্রসঙ্গে কমিটির সদস্য এবং বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, একটি চুক্তি বাতিল করতে চাইলে কিছু যৌক্তিক কারণ লাগে। কোনো পক্ষ যদি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে বা চুক্তি স্বাক্ষরে অনিয়মের প্রমাণ মেলে, তাহলে তা নিয়ে পর্যালোচনা করা যাবে। ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে মুক্তি প্রসঙ্গে হাসিব চৌধুরী বলেন, চুক্তি পর্যালোচনা ছাড়াও পুরোনো ও অদক্ষ কেন্দ্র বাতিল, চুক্তির মেয়াদ নবায়ন না করা, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আর নতুন কেন্দ্রের চুক্তি না করে রিজার্ভ মার্জিন কমিয়ে আনতে হবে।