ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেকই নারী। তাই নারী ভোটারদের পক্ষে রাখতে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি শোনাচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা। যদিও প্রতিশ্রুতির ভিড়ে উপেক্ষিত থাকছে কর্মসংস্থানের যৌক্তিক সমস্যা, সামাজিক নিরাপত্তা কিংবা রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার মতো বিষয়। নারীরা বলছেন- কাজের পরিবেশসহ অধিকারের সুনির্দিষ্ট বিষয় প্রাধান্য দিতে হবে আসন্ন ইশতেহারে। এক্ষেত্রে শুধু সরকারি দল নয়, বিরোধী দলের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ- বলছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।
সকালে উঠেই দেড় বছর বয়সী সন্তানের জন্য খাবার তৈরির তোড়ঝোড়! তারপরই অফিসের জন্য ছোটা কর্মজীবী এই মায়ের।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জাহানারা ভূইয়ার রোজকার এই ছুটে চলার মাঝে সন্তানের জন্য তীব্র দুশ্চিন্তা। সন্তানের যত্নে কোনো ছাড় না দিতে চাইলেও দুধের বাচ্চাকে রেখে অফিস করা শারীরিক এবং মানসিকভাবে চাপে ফেলে তাকে। তবে সন্তানকে যদি নিজের অফিসে রেখে কাজের পাশাপাশি দেখভাল করতে পারতেন, তাহলে হয়তো কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেন তিনি।
জাহানারা ভূইয়া বলেন, ‘যাতায়াত ও অফিস মিলে আমাকে ১০ ঘণ্টা বাহিরে থাকতে হচ্ছে। বাচ্চাকে রেখে অফিস করা শারীরিক এবং মানসিকভাবে চাপে ফেলছে। কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না।’
জাহানারা ভূইয়ার মতো অনেক কর্মজীবী মায়ের লড়াই জীবনের সঙ্গে রয়ে সয়ে মিশে গেছে।
আরেকজন মা বলেন, ‘কর্মস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার না থাকা। একটা ডে কেয়ার সেন্টার।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ৮০ শতাংশ পুরুষের বিপরীতে দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৪ দশমিক ২ শতাংশই নারী। সব খাত মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় আড়াই কোটি নারী বর্তমানে কর্মে নিয়োজিত হলেও মাতৃত্বকালীন সুবিধা না দেয়া, চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের শঙ্কা, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য, কম বেতন, দ্বৈত দায়িত্বের বোঝা, সামাজিক সুরক্ষার অভাব যেন বেশিরভাগ নারীর নিত্যদিনের সঙ্গী।
একজন নারী কর্মী বলেন, ‘আমি ডিসিশন মেকিংয়ে ভালো। হয়তো একজন পুরুষ কর্মীর থেকে ভালো। এটা আমাকে অনেক জায়গা প্রমাণ করে তারপর যেতে হয়। যেটা পুরুষের ক্ষেত্রে করতে হয় না। এটা পরিবর্তন হওয়া উচিত বাংলাদেশে।’
নারী শ্রমিক বলেন, ‘মজুরি পুরুষ বেশি পায়। নারী কম পায়।’
শ্রমশক্তিতে অবদান রাখা এই নারীরাই রাষ্ট্রের জনগণ কিংবা ভোটার। তাই তো তাদের ভোট টানতে কেউ দিচ্ছে কর্মঘণ্টা কমানোর প্রতিশ্রুতি। কেউ আবার বলছেন, ৮ নয় ১২ ঘণ্টাও কাজের কথা।
কিন্তু, এতো এতো প্রতিশ্রুতির ভিড়ে নারীর আসল সমস্য কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে নির্বাচনি বক্তব্য কিংবা প্রতিশ্রুতিতে? কিংবা কতটা স্থান পাবে আগামী ভোটের দলীয় শহরগুলোতে?
শেরপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. সানসিলা জেবরিন প্রিয়াংকা বলেন, ‘আমাদের নারীরা যেন ইভটিজিংয়ের শিকার না হয়। তারা যেন সমাজে ভালোভাবে চলতে পারে সেই ব্যাপারে আমরা বিশেষ ভূমিকা রাখবো।’
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘এনসিপি যদি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পায় তাহলে সিস্টেমিক ও সামাজিক আন্দোলন প্রতিরোধের মাধ্যমে এটা সমাধান করার চেষ্টা করবে।’
তবে নির্বাচনের পর এসব প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবায়ন হয়? তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট শঙ্কা। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু ভোটের মাঠের প্রতিশ্রুতিই নয়- বরং কর্মক্ষেত্র নারীবান্ধব করার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালার পাশাপাশি শক্তিশালী কাঠামো ও সামাজিক সমর্থন প্রয়োজন।
সমাজ বিশ্লেষক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘নির্বাচনের আগে নারীদের স্পেস দেয়া হলেও নির্বাচনের পরে নারীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। যেই দায়িত্ব নেবে তার উচিত একটা নারীবান্ধব সমাজ তৈরি করা। নারীবান্ধব কর্ম পরিবেশ তৈরি করা’
তিনি বলছেন, নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি রক্ষায় নারীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি শুধু সরকার গঠনকারী দলের নয়, বরং অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিরোধীদলের চাপও অনেক বড় ভূমিকা হিসেবে কাজ করতে পারে।