দুই পায়ে শক্তি নেই, ডান হাত প্রায় অচল, শুধু বাঁ হাত আর ইচ্ছাশক্তিকে সঙ্গী করে বগুড়ার ধুনটের নাইছ খাতুন অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় তার জিপিএ ৩.০২। শারীরিক সীমাবদ্ধতা তাকে দমাতে পারেনি কখনোই।
ধুনট উপজেলার বহালগাছা গ্রামের দরিদ্র নজরুল ইসলামের মেয়ে নাইছ খাতুন। পরিবারে জন্ম নেওয়া নাইছ ছোটবেলা থেকেই হাঁটতে পারেন না। তাই স্কুল-কলেজে তাকে যেতে হয়েছে বাবার কোলে চড়ে। প্রায় দুই দশক ধরে বাবা নজরুল ইসলাম কখনো রোদে, কখনো বৃষ্টিতে, কখনো কাঁদা মাড়িয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন।
নাইছ ২০০২ সালে বহালগাছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও পরে বহালগাছার বিশ্বহরিগাছা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
নাইছের বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, মানুষ বলে প্রতিবন্ধী, আর আমি দেখি আমার মেয়েকে একজন যোদ্ধা। ওকে কোলে করে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া কখনোই কষ্ট মনে হয়নি। আমার মেয়ের ফল দেখে মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বাবা।
তিনি আরও বলেন, অনেক ডাক্তার দেখালাম, কবিরাজ দেখালাম, তবুও কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু ওর মনোবল দেখে আমরা হার মানিনি। আজ ফল দেখে মনে হচ্ছে আমাদের সব কষ্ট সার্থক।
এদিকে ফলাফল জানার পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাইছ খাতুন বলেন, আমার শরীর দুর্বল, কিন্তু মনটা খুব শক্ত। ছোটবেলায় মানুষের আড়চোখের তাকানো খুব কষ্ট দিত, এখন তারা উৎসাহ দেয়, ভালোবাসে। ভবিষ্যতে আমি শিক্ষক হয়ে সমাজের উপকার করতে চাই।
নাইছের এ সাফল্যে পরিবার, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পুরো গ্রাম আনন্দিত।
নাইছের বন্ধু আব্দুর রহিম বলেন, আমরা সবাই হাঁটতাম, দৌড়াতাম, খেলতাম, নাইছ পারত না। কিন্তু পড়ার ক্ষেত্রে ও ছিল আমাদের সবার আগে। ওর মনোবল এতটাই শক্ত যে আমরা অনেক সময় লজ্জা পেতাম, ওকে দেখে নিজেরাই অনুপ্রাণিত হতাম। আজ নাইছের সাফল্য আমাদের পুরো বন্ধুমহলের গর্ব।
পাড়া প্রতিবেশী চাচা মো. জামাল শেখ বলেন, নাইছকে দেখলে মনে হয় আল্লাহ বিশেষ কোনো শক্তি দিয়েছেন। ওর শরীর না পারলেও মনটা প্রতিদিনই লড়ে গেছে। গ্রামে অনেকেই একসময় ভাবত, এই মেয়ে কি আদৌ পড়ালেখা করতে পারবে। আজ সেটা ভুল প্রমাণ করে নাইছ দেখিয়েছে ইচ্ছাশক্তি থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা ওর জন্য দোয়া করি, যেন আরও বড় হয়।
বিশ্বহরিগাছা-বহালগাছা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শেখ সাদি বলেন, নাইছের চোখে আমি সবসময় স্বপ্ন দেখতাম। শরীর তাকে থামাতে পারেনি। এই মেয়ের ইচ্ছাশক্তি আমাদের ছাত্রদের জন্যও এক বিশাল অনুপ্রেরণা। ও গ্রামের ইচ্ছাশক্তির প্রতীক হয়ে উঠছে নাইছ। ধুনটের সাধারণ মানুষ এখন তাকে ডাকে অনুপ্রেরণা বলে।