চলতি বছর চট্টগ্রামে সাতটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক এসব হত্যাকাণ্ডের আগে একটি ভয়ংকর মিল পাওয়া গেছে। হত্যার আগেই হুমকি আসত মোবাইল ফোনে বা ফেসবুকে। কারো ক্ষেত্রে হুমকি পাওয়ার তিনদিনের মাথায়, কারো ক্ষেত্রে এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘটত নৃশংস খুন। সিরিজ এই হত্যাকাণ্ডের কেন্দ্রে যে নামটি উঠে আসে, তিনি হলেন- ‘সিরিয়াল কিলার’ হিসেবে খ্যাত মো. রায়হান আলম।
চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম
সদস্য তিনি। হত্যাকাণ্ডগুলোর আগে সরাসরি হুমকি দিতেন। সাতটি হত্যাকাণ্ডের সবটাই তিনি আসামি। চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদের ডানহাত হিসেবেই উঠে আসে রায়হানের নাম। ফেসবুকে ‘মৃত্যুর কাউন্টডাউন’ টাইপ বার্তা, ফোনে সরাসরি হত্যার ভয়Ñএই দুই পথেই টার্গেটকে মানসিকভাবে কোণঠাসা করে রাখতেন রায়হান। আর সেই হুমকি বাস্তবায়িত হতো কয়েক দিনের মধ্যেই। ভয়ঙ্কর এ ধরনের কারণে তাকে স্থানীয়রা বলছেন হুমকি দেয়, তারপর খুন করেÑএটাই রায়হানের স্টাইল।
সর্বশেষ ৫ নভেম্বর বায়েজিদের চালিতাতলী এলাকায় বিএনপির গণসংযোগে আরেক সন্ত্রাসী সরওয়ার হোসেন বাবলা খুন হন। তাকে খুন করার তিনদিন আগেই ফোনে হুমকি দিয়েছিলেন বিভিন্নভাবে। রায়হান বলেছিলেন, চট্টগ্রাম শহরে বাবলা বাঁচতে পারবে না। তাকে মেরে রাউজানে ঢুকব। আরেকটাতে হুমকি দিয়েছিলেন, যা খাওয়ার খেয়ে নে, এক সপ্তাহের মধ্যে তোর মৃত্যু হবে। এসব হুমকি বাবলা খুন হওয়ার এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন আগে এসেছিল।
বাবলার ছোট ভাই ইমরান খান আজিজ আমার দেশকে বলেন, এই রায়হানই আমার ভাইকে হত্যা করেছে। এর আগে সে বড় সাজ্জাদের নির্দেশে ‘চট্টগ্রাম শহরে বাবলা বাঁচতে পারবে না’ বলে হুমকি দিয়েছিল।
বাবলা ছাড়াও গত অক্টোবরে রাউজানে যুবদলকর্মী মুহাম্মদ আলমগীর আলমকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনায় রায়হানের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এক ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেও রায়হানকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা গেছে তাকে।
এর কয়েকদিন পর মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময় রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চারাবটতল বাজারসংলগ্ন কায়কোবাদ জামে মসজিদের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় আলমকে। এ সময় তার স্ত্রী ও সন্তান পেছনে একটি অটোরিকশায় ছিলেন।
নিহত আলমের ছেলে আশফায়েত হাসেন বলেন, আমার চোখের সামনেই বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে রায়হান। বাবার সঙ্গে থাকা দুজনও গুলিবিদ্ধ হন। আমার ধারণা, কেউ আগে থেকে পরিকল্পনা করে ভাড়াটে রায়হানকে দিয়ে বাবাকে খুন করিয়েছে।
নিহত বাবলার ছোট ভাই মো. ইমরান খান আজিজ বলেন, আমার ভাই বাবলাকেও রায়হান হত্যা করেছে। গুলি করে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে দেখেন।
গত ৩০ মার্চ নগরীর বাকলিয়া এক্সেস রোডে প্রাইভেটকারে থাকা বখতিয়ার হোসেন মানিক ও আব্দুল্লাহ আল রিফাতকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মামলায় ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্নার সঙ্গে রায়হানকেও আসামি করা হয়। পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও রায়হান এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এছাড়া রাউজানের কদলপুর ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব মো. সেলিম, রাউজান ইউনিয়নের যুবদল কর্মী মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও ঢাকাইয়া আকবরকে হত্যায় জড়িত রয়েছে তার নাম। এর মধ্যে ঢাকাইয়া আকবরকে হত্যার আগে তাকেও হুমকি দিয়েছিল বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
এবার ওসিকে হুমকি, সঙ্গে খুনের লিস্ট
এবার রায়হান আলম তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আবারও সরাসরি হত্যার হুমকি দিয়েছেন। এমনকি হুমকি দিয়েছেন রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও। পলাতক রায়হানের এসব পোস্টে প্রতিপক্ষকে ‘ভয়ংকর মৃত্যু’, ‘খেলা শুরু’ এবং ‘টাকার কারিশমায় মামলা’Ñএমন ভাষায় সহিংসতার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এসব পোস্ট ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয়দের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
গত কয়েক দিনে পরপর কয়েকটি পোস্টে রায়হান লিখেছেন, খারাপের শেষ দেখাই ছাইড়া দিমু তোমাদের। এক পোস্টে তিনি আজিজ নামে একজনের নাম ধরে লেখেন, আজিজের দালাল যারা আছে, তাদের নাম-ঠিকানা ইনবক্সে দেন। বাকিটা আমি দেখে নেব। তিনি দাবি করেন, কোনো তদন্ত ছাড়া টাকার বিনিময়ে তার নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। তার মন্তব্য, আমি মাসিক বান্ডেল মারতে পারি নাই তাই আমার পিছনে বাঁশ দিয়েছে। এগুলো কি টাকার কারিশমা না?
এসব পোস্ট ৫ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ফেসবুকে লিখেন। তার ফেসবুক আইডির নাম রায়হান আলম। তার কাছের কয়েকজন এটি রায়হান আলমের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বলে নিশ্চিত করেছেন। রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলামও নিশ্চিত করেছেন। প্রতিপক্ষকে সরাসরি হত্যার হুমকি রায়হানের পোস্টগুলোর সবচেয়ে আলোচিত অংশে একজন ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে তিনি লেখেন, তোর মৃত্যু হবে সবচাইতে ভয়ঙ্কর। কুকুরে তোর নাড়িভুঁড়ি টেনে টেনে খাবে।
নিজেকে এখনো এলাকায় সক্রিয় দাবি করে রায়হান লিখেছেন, আমি হারিয়ে যাইনি তোমাদের তামাশা দেখতেছি দূর থেকে। স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, এটি কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের টার্গেট করার কৌশল হতে পারে। সব শেষে রায়হান রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলামকে উদ্দেশ করে লেখেন, মামলা-বাণিজ্য বন্ধ করুন। সঠিক তদন্ত না করে টাকার বিনিময়ে মামলা দিলে রাউজানের পরিস্থিতি আপনার কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে।
ওসি মনিরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, আমাকেও সরাসরি হুমকি দিয়েছেন। এছাড়া অনেক লোককেও হত্যার হুমকি দিয়েছেন। আমরা তাকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
জানতে চাইলে জেলার পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সান্তু বলেন, হয় পুলিশ থাকবে না হয় সন্ত্রাসী। যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। অনেককে ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
কে এই রায়হান
রাউজানের সাত নম্বর রাউজান ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডের জুরুরকুল খলিফা বাড়ির মৃত বদিউল আলমের ছেলে মো. রায়হান। চট্টগ্রাম পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের অন্যতম সহযোগী। তার বিরুদ্ধে খুন, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
পুলিশ জানায়, রায়হানের বিরুদ্ধে গত বছরের ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় জোড়া খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৪টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি হত্যা মামলা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ছোট সাজ্জাদের বাহিনীতে রয়েছে ২৫ জন সক্রিয় সদস্য। গত ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিংমল থেকে সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বাহিনীর হাল ধরে পাঁচ সহযোগী। তাদের অন্যতম সাজ্জাদের ডান হাত হিসেবে পরিচিত রায়হান। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিত রায়হান।