Image description

ডান পায়ের ঊরু পর্যন্ত অন্তত পাঁচ স্থান ভাঙা। রিং আর রড প্যাঁচানো পা ফুলে ঢোপ হয়ে আছে। খানিকটা নড়াচড়া করতেই ব্যথায় চিৎকার দিয়ে ওঠে কিশোর আব্দুল্লাহ আহমাদ। তা সইতে না পেরে পাশে থাকা মা সৃষ্টিকর্তার কাছে দুহাত তোলেন-‘হে আল্লাহ যত ব্যথা, যত কষ্ট আমায় দাও, আমার আব্দুল্লাহকে দিও না।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে এবার নিজের যন্ত্রণা লুকানোর চেষ্টা করে ১৭ বছর বয়সি এ কলেজছাত্র। আব্দুল্লাহ ১৬৮ দিন ধরে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) রয়েছেন। ১২ তলা ভবনের তৃতীয়তলায় চিকিৎসা চলছে তার।

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল আব্দুল্লাহ। ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বর সড়কে রাস্তায় সটান দাঁড়িয়ে ছিল আব্দুল্লাহ। পুলিশের একটি দল তার ওপর কাভার্ডভ্যান চালিয়ে দেয়। আব্দুল্লাহর ডান পা ও বাম পায়ের একটি অংশ থেঁতলে যায়। গুলিও চালায় বাহিনীর বর্বর সদস্যরা। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সে। তবে জীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার, তা পূরণ যে এখন দুরূহ-সেটিই এখন তাকে কাঁদাচ্ছে বেশি।

মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালের বিছানায় বসে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলে আব্দুল্লাহ আহমাদ। বলছিল, পা তো বটেই, পুরো শরীরে ক্ষণে ক্ষণে তীব্র ব্যথা হয়। পা ফুলে আছে, যেন কলাগাছ। রড আর নাটবল্টুগুলোর দিকে তাকালে আঁতকে ওঠেন। কষ্ট-ব্যথার মধ্যেও কাল (আজ) পরীক্ষা দেব। আর্মি অফিসার হতে যত পড়তে হয় পড়ব।

ঢাকা আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ। এ কলেজে এসএসসিতে সে সর্বোচ্চ মার্ক পেয়েছিল। কলেজটিতে ভর্তিই হয়েছিল মা-বাবা এবং নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে আবদুল্লাহ বলে, ‘আর্মি অফিসার হব’ই। বুঝ হওয়ার পর থেকেই স্বপ্ন দেখছি। মায়েরও স্বপ্ন ছিল আর্মি অফিসার হওয়ার। আমি যদি আর্মি অফিসার না হতে পারি... বলতেই দুচোখের অশ্রু গাল বেয়ে গড়াচ্ছিল। সঙ্গে মাও কাঁদছিলেন।

মা বিলকিস আক্তার বলেন, ১৬৮ দিন ধরে ছেলের সঙ্গে আছি। আমার সন্তানও শহিদ হতো, প্রাণে বেঁচে গেছে। জুলাই মাসে যখন ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ গর্জে উঠছিল-তখনই সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তার বাবা এবং আমি অনুমতি দিই-‘যা বাবা, মরলে শহিদ হবি, জীবন দিয়ে হলেও নতুন স্বাধীনতা আনবি।’ কষ্ট শুধু একটাই, আমাদের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন আমিও দেখেছিলাম, উচ্চতা কম হওয়ায় সম্ভব হয়নি। ছেলের উচ্চতা অনেক, মেধাবী ছাত্র। রাষ্ট্র, প্রধান উপদেষ্টা বা সেনাপ্রধান-তাদের কাছে প্রার্থনা, আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুন।

সংসারে অভাব, অনটন বাড়ছে জানিয়ে বিলকিস আক্তার জানান, তার স্বামী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ৬ মাস ধরে সবই বন্ধ। আগেও খেয়ে না খেয়ে সন্তানকে পড়াতেন। মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের (জুলাই বিপ্লবের) সন্তানরা কি পাচ্ছে? এখন পর্যন্ত অনেকেই হেলথ কার্ড পায়নি। আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কোথায়। যাদের রক্তে নতুন স্বাধীন দেশ হলো-তারা কেন উপেক্ষিত। তিনি আরও জানান, সরকারের কাছ থেকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পেয়েছেন ১ লাখ ৭০০ টাকা। বিলকিস আক্তারের ভয়, নির্বাচন হয়ে গেলে, কী হবে-শহিদ এবং আহতদের উন্নয়নে কে কতটুকু করবে?

এদিকে জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আব্দুল্লাহর মা বিলকিস আক্তার। বললেন, সারজিস আলমও তাদের আর্থিক সহায়তা করেছেন। এ সহযোগিতা তাদের পরিবারের জন্য কল্যাণ হয়েছে।

আব্দুল্লাহর বিশ্বাস সে সুস্থ হয়ে উঠবে। চিকিৎসক বলেছেন, তার উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ যেতে হবে। দেশে কিংবা বিদেশে, তারসহ আহতদের চিকিৎসা যেন পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়। তাদের চাকরি-আর্থিক ব্যবস্থার নিশ্চয়তা যেন করা হয়। বড় ভাইবোন-সমন্বয়ক যারা এবং সরকারের উপদেষ্টারা যেন তাদের প্রায়ই দেখতে আসেন। তাদের দেখলে মনে সাহস আসে, যোগ করেন আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহর ভাষ্য, পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতাল থেকেই ভাড়া করা গাড়িতে কলেজে যান। প্রতিবার ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা খরচ হয়।

হাসিনা ও তার দলের প্রতি ঘৃণা জানিয়ে বিলকিস আক্তার বলেন, ‘হাসিনা খুনি। তার সরাসরি নির্দেশে আহতদের হত্যা করতে বলা হয়েছিল ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ লীগদের। সেই ভয়ে আমার ছেলে যখন রাস্তায় পড়ে কাঁতরাচ্ছিল তখন রাস্তা থেকে তুলে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মাদারীপুর পাচ্চর রয়েল হাসপাতালে ভর্তি করাই। ওখানেও হাসিনার ভয় ছিল। ভয়ে ছিলাম পুরো পরিবার। গোপনে চিকিৎসা করাচ্ছিলাম। যখন দেশ স্বাধীন হলো, ৭ আগস্ট ছেলেকে পঙ্গু হাসপাতালে আনি।

অনটনের মধ্যে রয়েছেন জানিয়ে বিলকিস আক্তার বলেন, চিকিৎসক বলছেন, ছেলেকে নিয়ে আরও প্রায় দেড় থেকে ২ বছর হাসপাতালে থাকতে হবে। আরেকটা ছেলে আছে, ১০ম শ্রেণিতে পড়ছে। পুরো সংসারটা শেষ, রোজগার নেই। মাসের পর মাস হাসপাতালে থাকতে হবে। কখন বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানো হবে-তাও নিশ্চিত নয়। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেই চোখের পানি আসে, ছাত্র-জনতার সরকার যদি তাদের জন্য সর্বোচ্চ কিছু না করে-অন্য সরকার কি করবে?