Image description

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন পেশাজীবীরা আন্দোলন শুরু করেন নানান দাবি-দাওয়া নিয়ে। এর মধ্যে আলোচিত হয়ে ওঠে দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আন্দোলন কর্মসূচি। এর মধ্যে পুরোপুরি সফল হয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের আন্দোলন। আর সহকারী শিক্ষকরা সরকারের অপেক্ষায় রয়েছেন। এছাড়া এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিছুটা দাবি আদায় করতে পেরেছেন। অন্যরা আন্দোলনে থাকলেও কোনও ফল পাননি।

বিগত সরকারের সময় থেকে এসব আন্দোলন শুরু হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় শিক্ষকদের আন্দোলন সবচেয়ে বেশি। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন আন্দোলন করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি জানাচ্ছেন সবাই?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষকরা মাঠে নেমেছেন নতুন সরকারের কাছে। বৈষম্যহীন দাবি করা সরকারের কাছ থেকে সহজেই অনেকেই তাদের দাবি আদায় করে নিয়েছেন। এমনকি এসএসসি ও সমমানের শিক্ষার্থীরাও সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল আদায় করে নিয়েছেন, যাকে সবাই ‘অটোপাস’ বলে থাকেন। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে সবাই তাদের `যৌক্তিক দাবি' আদায়ের চেষ্টা করছেন, আর তাই বছরজুড়েই আন্দোলন কর্মসূচি চলছে।

বুধবার (১২ নভেম্বর) পর্যন্ত আন্দোলনে থাকতে দেখা গেছে স্বতন্ত্র এবতেদায়ি শিক্ষকদের। বারবার নানা আশ্বাস পেলেও নিয়োগ না পাওয়ায় প্রথম থেকে ১২তম নিবন্ধিত নিয়োগ বঞ্চিত শিক্ষকরা। এছাড়া আন্দোলনে রয়েছেন পাঁচ দফা দাবি আদায়ে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আর সোমবার (১০ নভেম্বর) রাতে আন্দোলন শেষ করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা।

বছরজুড়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলনে আরও ছিলেন এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজের নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষক, বৃত্তি পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন করেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে, ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশের পর আন্দোলন করেছেন রাজধানী ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর আগে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত ও আলাদা আলাদা দাবিতে আন্দোলন ছিল আলোচিত ঘটনা।

এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ঢাকা কলেজে, ঢাকা সিটি কলেজ এবং আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ও আন্দোলন প্রায়শই রাজধানীতে ভোগান্তির মধ্যে ফেলেছে। সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজ শিক্ষার্থীরা শান্তিচুক্তি করলেও ঢাকা সিটি কলেজ সেই চুক্তিতে যায়নি।

৮ নভেম্বর পুলিশ শিক্ষকদের ওপর জলকামান এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ছবি: আহাদুল করিম খান/ঢাকা ট্রিবিউন৮ নভেম্বর পুলিশ শিক্ষকদের ওপর জলকামান এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ছবি: আহাদুল করিম খান/ঢাকা ট্রিবিউন

নীতিমালার ফাঁদে অনার্স শিক্ষকদের আন্দোলন

গত বছরের শুরুতে  আন্দোলন কর্মসূচিতে রাজপথে নামেন  দেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি ৩১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা। ৩২ বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরি করা এসব শিক্ষকরা নতুন করে আন্দোলন শুরু করেন গত বছরের ১৫ থেকে ১৭ অক্টোবর। শিক্ষা ভবনের সামনে টানা তিন দিন আন্দোলন করেন বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের এই শিক্ষকরা। আন্দোলনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন লাঠিচার্জ, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে শিক্ষকদের আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। আহত হন বেশ কয়েকজন শিক্ষক, যাদের মধ্যে শিশুসন্তানসহ নারী শিক্ষকও ছিলেন।

পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) ২০১৮ সালের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। তবে নীতিমালা সংশোধন হয়নি গত এক বছরেও।

বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে গত অক্টোবরে বলেছিলেন, ‘আন্দোলনের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়, সে কারণে আন্দোলন থেকে সরে এসেছিলাম। আমরা চাই দ্রুত জনবল ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা নিক। তবে অক্টোবরের মধ্যে নীতিমালা সংশোধন হয়নি। নভেম্বর থেকে আবার আন্দোলন কর্মসূচির কথা থাকলেও এখনও আমরা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করিনি।’

প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের আন্দোলন

দশম গ্রেডসহ তিন দফা দাবিতে গত ৮ নভেম্বর শনিবার সকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। আন্দোলন চলাকালে পুলিশের লাঠিচার্জ, জলকামান, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড হামলার শিকার হন। এই শিক্ষকদের দাবি ছিল- সহকারী শিক্ষকদের বর্তমান বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা; শিক্ষকদের ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির বিষয়ে জটিলতার অবসান; এবং সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি।

তবে সোমবার রাতে মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে অবস্থান কর্মসূচি ও কর্মবিরতি স্থগিত করেন শিক্ষকরা। শিক্ষকরা ১১তম গ্রেড চেয়ে না পেয়ে দশম গ্রেডে বেতন চেয়ে আন্দোলন শুরু করেন।

সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড নির্ধারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু তাহের মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে পে-কমিশনকে অনুরোধ করেছি ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার জন্য। আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছি।’

২০টি থেকে ১২টি গ্রেড করার কোনও সিদ্ধান্ত রয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতটুকু শুনেছি, আমার মনে হয় গ্রেড কমাবে পে-কমিশন।’

তবে পে-কমিশনকে বেতন গ্রেড ভেঙে ২০টি গ্রেড থেকে ১২টি করতে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে হবে বলে জানিয়েছে পে-কমিশন। আর সরকার থেকে বলা হয়েছে পরবর্তী সরকার পে-কমিশন বাস্তবায়ন করবে। এতে শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির (কাসেম-শাহীন) সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড নির্ধারণে সিদ্ধান্ত দিলেও সহকারী শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। তাদের দাবি যৌক্তিক। অতি দ্রুতই সরকারের যৌক্তিক সমাধানে আসা উচিৎ।’

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি নবম দিনেও অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় শহীদ মিনার এলাকা থেকে তোলা ছবি। (ফাইল ছবি/ নাসিরুল ইসলাম)এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি। জাতীয় শহীদ মিনার এলাকা থেকে তোলা ছবি। (ফাইল ছবি/ নাসিরুল ইসলাম)

প্রধান শিক্ষকদের আন্দোলন

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা এক দিন আন্দোলন করে দাবি আদায়ে সফল হয়েছেন। তাদের দাবি ছিল দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণসহ চার দফা। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড, ২০১৪ সালের ৯ মার্চ থেকে সব প্রধান শিক্ষকের ১০ম গ্রেডের জিও জারি, চলতি দায়িত্বসহ সিনিয়র শিক্ষকদের শতভাগ পদোন্নতি এবং ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড। সরকার প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়।

আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. শামছুদ্দিন মাসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। ন্যায্য দাবিতে সহকারী শিক্ষকদের পক্ষে আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। মন্ত্রণালয়ও বলেছে আন্দোলন যৌক্তিক।’

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বাড়ানোর আন্দোলন

মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ টাকা করা এবং উৎসব ভাতা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করার দাবিতে আন্দোলন করেন এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকরা-কর্মচারীরা। আন্দোলনের ১০ দিনের মাথায় অর্থ বিভাগ নতুন করে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির সম্মতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। এরপর শিক্ষকরা তাদের আন্দোলন স্থগিত করেন।

শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া। নভেম্বর থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ এবং আগামী বছর থেকে সাড়ে সাত শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অনেক আলাপ আলোচনা করে তা করা হয়েছে। এরপর আমরা আন্দোলন থেকে ক্লাসে ফিরেছি।’

ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের লাগাতার আন্দোলন

ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রম জাতীয়করণের দাবিতে গত ১২ অক্টোবর থেকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষকরা। তারা গত ৩০ অক্টোবর বিকালের মধ্যে এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশের আল্টিমেটাম দেন এবং ২ নভেম্বর প্রেসক্লাব থেকে যমুনা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দেন।

শহীদ মিনারে শিক্ষকদের অবস্থান (ফাইল ছবি)শহীদ মিনারে শিক্ষকদের অবস্থান (ফাইল ছবি)

গত ২৯ অক্টোবর সচিবালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও জলকামান নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এতে আহত হন অর্ধশতাধিক শিক্ষক, যাদের অনেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই সময় চিকিৎসা নেন। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আন্দোলন গড়াল ৩২ দিনে। তবে অনেক আন্দোলনের ভিড়ে এই আন্দোলনটি আলোচনায় এসেছে কম।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি শিক্ষক ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান কাজী মোখলেছুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সচিবালয়ে সচিবের সঙ্গে শিক্ষক প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন অনুদানবিহীন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার দাবি-দাওয়া যৌক্তিক। এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে পরামর্শ করে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এ জন্য চলতি সপ্তাহের দুই কর্মদিবস সময় নিয়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালে আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটি অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন গত ১০ নভেম্বর। অনুদানভুক্ত এক হাজার ৫১৯টি প্রতিষ্ঠানের জন্য এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চিঠি ইস্যু করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়। তবে অন্যান্য মাদ্রাসাগুলোর এমপিওভুক্তির জন্য অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।

সরকার থেকে বলা হয়েছে, ক্রমান্বয়ে সব মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে যাবেন। আর শিক্ষকরা বলেছেন, ‘জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন হলেও এমপিওভুক্তি প্রজ্ঞাপন পেলেই আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো।’

প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন

সব বিশেষ (অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী) বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তি সুনিশ্চিত করাসহ পাঁচ দাবিতে আন্দোলন করছেন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) ১৭ দিনেও তাদের আন্দোলনে দেখা গেছে।

তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, সব বিশেষ বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামো সুনিশ্চিত করতে হবে; বিশেষ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি তিন হাজার টাকা নিশ্চিত করতে হবে; শিক্ষার্থীদের মিড-ডে মিলসহ উচ্চ উপকরণ দিতে হবে। এছাড়া খেলাধুলা সরঞ্জাম দেওয়া ও থেরাপি সেন্টার বাস্তবায়ন করতে হবে; ছাত্র-ছাত্রীদের ভোকেশনাল শিক্ষা কারিকুলামের আওতায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পুনর্বাসন সুনিশ্চিত করতে হবে এবং সব চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নির্ধারিত কোটা সুনিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মো. ইলিয়াস রাজ, মুখ্য সমন্বয়ক গাউসুল আজম শীমু, সাধারণ সম্পাদক রিমা খাতুন, সমন্বয়ক এম এ সালাম, মো. আসাদুজ্জামান, অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসাইন এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনটি ১৭ দিনে গড়ালেও তেমন গুরুত্ব পায়নি। তবে ৯ নভেম্বর দুপুর দেড়টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে শিক্ষকরা মিছিল নিয়ে পল্টন মোড় ঘুরে এসে সচিবালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের সচিবালয়ের ৫ নম্বর গেটের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়।

শিক্ষক নিবন্ধন পাওয়া প্রার্থীদের আন্দোলন

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন পাওয়া শিক্ষকরা বছরজুড়েই আন্দোলন করে আসছেন। রবিবার (৯ নভেম্বর) অবস্থান কর্মসূচি শেষে যমুনা অভিমুখে লংমার্চ করার কথা ছিল তাদের। কিন্তু সোমবার (১০ নভেম্বর) নিয়োগ বঞ্চিতদের সমস্যা প্রধান উপদেষ্টার কাছে পৌঁছানো হবে এ আশ্বাসে লংমার্চ কর্মসূচি স্থগিত করেন তারা।

নিবন্ধিত শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, বিগত সময়গুলোতে ২০০ দিনের আন্দোলন করলেও বিভিন্ন সময় প্রশাসনের আশ্বাস পেয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়োগ পাননি। জাল সনদধারীরা নিয়োগ পেয়েছেন, অথচ বৈধ সনদধারীরা এখনও বঞ্চিত।

১৯ অক্টোবর রাজধানীতে থালা-বাসন হাতে ভুখা মিছিল করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। ফাইল ছবি: নাসিরুল ইসলাম১৯ অক্টোবর রাজধানীতে থালা-বাসন হাতে ভুখা মিছিল করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। ফাইল ছবি: নাসিরুল ইসলাম

এই প্রার্থীদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই বলে বার বার জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়। যদিও তা মানতে নারাজ নিবন্ধন পাওয়া প্রার্থীরা।

আন্দোলনের যৌক্তিকতা

প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষকদের আন্দোলনে ১১তম গ্রেডের দাবি যৌক্তিক বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। তবে সরকারের সামর্থ্য নেই তা বাস্তবায়ন করার। যদিও প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড মেনে নেওয়া হয়েছে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের তিন দফা দাবি যৌক্তিক বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার। তবে সরকারের সামর্থ্য নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অবশেষে আন্দোলনের মুখে দুই দফায় ১৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় মন্ত্রণালয়।

এবতেদায়ি আন্দোলন প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এমপিওভুক্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এখন জাতীয়করণের দাবি যথোপযুক্ত নয়। গত ১০ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যৌক্তিক দাবি মেনে অনুদান পাওয়া এক হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়য়ের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির অনুমোদন দিয়েছে। অন্য মাদ্রাসাগুলোর অনুমোদন পর্যায়ক্রমে হবে বলে জানিয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।

শিক্ষক আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কলেজের অধ্যক্ষ বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক, না মানার কোনও অর্থ নেই। এটি তাদের ন্যূনতম চাওয়া। তবে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট থেকেই যাবে। তাই দ্রুত এই দাবি আদায়ের জন্য আবারও শিক্ষক সমাজকে সোচ্চার হওয়া দরকার।’

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আবুল কাসেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণি (নবম গ্রেড) এবং সহকারী শিক্ষকদের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণি (দশম গ্রেড) দাবি করে আসছি। শিক্ষকদের যেমন সম্মান প্রয়োজন, তেমনি সংসার চালানোর মতো অর্থও প্রয়োজন। একজন সহকারী শিক্ষক প্রবেশকালে সর্বমোট বেতন পান ১৭ হাজারের মতো। এই অর্থ দিয়ে ঢাকা শহর কেন, মফস্বল শহরেও চলবে না। আর প্রধান শিক্ষকরা প্রবেশকালে বেতন পান ১৯ হাজার টাকার মতো। অথচ পাঠদান ছাড়াও শিক্ষকদের সরকারের বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ যোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করে যদি সংসার চালাতে কষ্ট হয়, সম্মান নিয়ে সমাজে চলতে সমস্যা তৈরি হয়, তাহলে মানসম্মত টেকসই শিক্ষা আশা করা যায় না। শিক্ষকদের অসন্তোষ নিশ্চয় তারা বুঝবেন; যাতে আমাদের আন্দোলন করতে না হয়।’

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. শামছুদ্দিন মাসুদ এবং বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির (শাহিন-লিপি) সাধারণ সম্পাদক খায়রুন নাহার লিপি শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক বলে উল্লেখ করেন।

খায়রুন নাহার লিপি বলেন, ‘পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, নার্স, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ সচিব, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা দশম গ্রেডে বেতন-ভাতা পান। সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন লড়াই করেও ১১তম গ্রেড পায়নি। তাই এখন দশম গ্রেড নির্ধারণসহ তিন দফা দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছিলেন শিক্ষকরা।’

অর্থ উপদেষ্টা উদারতা দেখিয়ে শিগগিরিই ১১তম গ্রেড বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন।