Image description
 

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। আর সে সুবাদে তারা ২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে দলীয় সরকারের অধীনে। ওই নির্বাচনে না এলেও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি ও জামায়াত। আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে এই নির্বাচন ঘিরে বিতর্কিত এক পদক্ষেপ নেয় আওয়ামী লীগ। আর তা বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে পুলিশ প্রশাসন।

দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তবে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সে সুযোগে ফাঁকা মাঠে গোল দেয় সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলটি। তবে দলের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে একাদশ নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি।

Kiswan

২০১৪ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশন থেকে তফলিস ঘোষণা হলেও সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি-জামায়াত জোট। ওই নির্বাচনের পর ফের ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন হয় দলীয় সরকারের অধীনে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না এলেও বিএনপি ও জামায়াত ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনের আগের রাতেই ভোটগ্রহণ শেষ করা হয়। আর নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাররা জানতে পারেন যে তাদের ভোট আগের রাতেই ব্যালট বাক্সে ঢুকে গেছে। বহুল আলোচিত এ নির্বাচন পরিচিতি পায় রাতের ভোটের নির্বাচন হিসেবে।


অভিযোগ রয়েছে, দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত ওই রাতের ভোটের নির্বাচনে প্রধান ভূমিকায় ছিল পুলিশ বাহিনী। পুলিশ সদর দপ্তরের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাসহ মাঠ পর্যায়ে প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপাররা ওই অপকর্মে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ওইসব পুলিশ কর্মকর্তা পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে উল্টো বিরোধী দলসহ সাধারণ জনগণের ওপর দমন-পীড়নে নেতৃত্ব দেন। আওয়ামী লীগও টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় টিকে গিয়ে ওইসব পুলিশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি ও পোস্টিংয়ের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।

তাৎপর্যের বিষয় হলো, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও পুলিশের ওইসব কর্মকর্তা রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। কেবল হাতে-গোনা কয়েকজনকে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। অন্যান্য অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন কয়েকজন।

বাংলাদেশ সিভিল ফোর্স নামের একটি ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সম্প্রতি ২০১৮ সালের রাতের ভোটের কারিগর পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ও ছবিসহ একটি তালিকা প্রকাশ হয়েছে। ওই তালিকা ধরে খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে, দেশের ৬৪ জেলায় রাতের ভোটের সময় পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরতদের অনেকেই চাকরিতে নিজেদের অবস্থান আরও পোক্ত করে নিয়েছেন। তাদের অনেকেই অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন।

মাঠ পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশের তিনটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুরো পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। মূলত ভোটবিহীন সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা পুরো বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন।

তারা জানান, ২০১৪ সালের নির্বাচনের সূত্র ধরে একইভাবে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পুলিশ কোনো দলের পক্ষ নেবে না বলে সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু মোড় ঘুরে যায় ওই নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত অংশ নেওয়ায়। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলও অংশ নেয়। ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবি হতে পারেÑ এমন গোয়েন্দা প্রতিবেদনও ছিল সরকারের কাছে। ফলে নির্বাচনের দুদিন আগেই সিদ্ধান্ত হয়Ñ কেন্দ্র দখল, বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী এবং তাদের কর্মী-সমর্থক ও ভোটকেন্দ্রের এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখাতে হবে। 

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশ সদর দপ্তরের তৎকালীন ডিআইজি (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান তার কক্ষে বসেই সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মী ও সাবেক এমপিদের নির্বাচনী এজেন্টদের তালিকা তৈরি করেন। সে অনুযায়ী শুরু হয় পুলিশের অভিযান। মাঠ পুলিশের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এবং হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আসতে থাকে। 

তবে এতকিছুর পরও আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত হতে পারেনি তারা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় ভোটের আগের রাতেই ব্যালট পেপারে সিল মারার। সে অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তারা যার যার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ভোটকেন্দ্রে রাতেই কারচুপি শুরু করেন। রাতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পক্ষে নৌকা প্রতীকে সিল দিয়ে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করা হয়। আর এভাবে কয়েকটি আসন বাদ দিয়ে বাকিগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করা হয়।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন জাভেদ পাটোয়ারী। আর পুলিশ সদর দপ্তরে ডিআইজি প্রশাসন হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন আছাদুজ্জামান মিয়া। 

ডিএমপির তৎকালীন উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, পুলিশ কর্মকর্তা প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদসহ গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ এলাকায় বাড়িÑ এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট ওই নির্বাচনে রাতের ভোটের মূল কারিগর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ওই নির্বাচনের পর আর রাতের ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) পুলিশ সপ্তাহে পদকও দেওয়া হয়। ওই বছর সর্বোচ্চ পদক দেওয়া হয় পুলিশকে। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে যা ইতঃপূর্বে আর কখনই হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে দেশের ৬৪ জেলায় পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ছিলেন ২০, ২১, ২২ ও ২৪ ব্যাচের। আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে তাদেরকে নির্বাচনের আগে থেকেই পছন্দের জেলায় পদায়ন করা হয়। আর সেই আস্থার প্রতিদান দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এসব কর্মকর্তা সব অপকর্মই করেছেন। তারা নির্বাচনের আগের রাতেই নৌকা প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট দিয়ে বাক্স ভরাটের ব্যবস্থা নেন। আর নির্বাচনের দিন সকালে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও ৫০ শংতাশের বেশি ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়।

অনসুন্ধানে জানা গেছে, রাতের ভোটের কারিগর হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরের সবকিছু মনিটরিং করেছেন পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান। তিনি তখন পুলিশ সদর দপ্তরে প্রশাসন বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তৎকালীন আইজিপির নির্দেশে রেঞ্জ ডিআইজি যার যার দায়িত্বে থাকা জেলার পুলিশ সুপারদের মনিটরিং করেন। আর কর্তাদের নির্দেশে পুলিশ সুপাররা কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মাঠ পুলিশ ও আনসার-ভিডিপি সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করেন। 

২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশের যেসব কর্মকর্তা আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে সহযোগিতা করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন অতি দ্রুত। পাশাপাশি পছন্দের জায়গায় পদায়ন নিয়েছেন। কেউ কেউ একাধিক জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতি-পদায়নেও ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘গণহত্যাসহ সরকারের পক্ষে কাজ করা পুলিশ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পর নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের স্বৈরাচারী মনোভাবের শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনগুলোতেও পুলিশ কর্মকর্তা এবং নির্বাচনে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নানা বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে ২০১৮ সালে রাতের ভোটের মাধ্যমে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ওই নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে তদন্ত করে চাকরিবিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘২০১৪ এবং সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনেও আমরা একই চিত্র দেখেছি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। এসব হামলার নেপথ্যে কারা ছিল, মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের কী ভূমিকা ছিল তা তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তাতে করে এটি ভবিষ্যতে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ 

এই সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখানে শুধু পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হবে না। তখনকার জেলা প্রশাসক, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা রাতের ভোটের মাধ্যমে একটি ভোটবিহীন সরকারকে ক্ষমতায় আসতে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘তৎকালে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা বলতে পারেন যে তারা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছেন। চাকরি বাঁচানোর জন্য তাদেরকে এসব করতে হয়েছে। কিন্তু আমি বলব- সরকার যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে অন্যায় আদেশ দেয় সেটি চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে।’ 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাতের ভোটের কারিগরদের একজন সাবেক ডিএমপি ডিবি প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশীদ। তিনি গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিপুল অর্থের মালিক হন। তার বিরুদ্ধে দখল, ডেকে এনে অর্থ আদায়ের অভিযোগ ছিল। এরপর ডিএমপিতে অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে ডিবিতে পদায়ন পান হারুন অর রশীদ। ডিবিতে দুই ভাগ করে অতিরিক্ত কমিশনার সাইবার এবং ডিবি উত্তর হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ডিআইজি পদোন্নতি নিয়ে তিনি হয়ে যান ডিএমপি ডিবিপ্রধান।

ডিবিতে বিএনপি নেতাকর্মীদের তুলে এনে নির্যাতন ও অর্থ আদায় করতে হারুন তৈরি করেন আয়নাঘর। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র সমন্বয়কদের নাহিদ ইসলামসহ ছাত্রদের তুলে এনে ভয়ভীতি ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আন্দোলনের সময় পুলিশের গণহত্যায় নেতৃত্ব দেন এই হারুন অর রশীদ।

রাতের ভোটের আরেক কারিগর শাহ মিজান শাফিউর রহমান। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকার সময় বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার করে নির্যাতনে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। 

সৈয়দ নুরুল ইসলাম পদোন্নতি পেয়ে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে পদায়ন পান। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করার কারণে পদোন্নতিতে কোনো বাধায় পড়তে হয়নি এ পুলিশ কর্মকর্তাকে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় পুলিশের এ কর্মকর্তা ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। রাতের ভোটের আরেক কারিগর আশরাফুল আজীম সরকার পতনের আগে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। আন্দোলনের সময় উত্তরায় গণহত্যায় তিনি নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই পুলিশ কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান। রাতের ভোটের কারিগর সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি বর্তমানে ভারতে রয়েছেন। রাতের ভোটের কারিগর মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, ডিআইজি কৃষ্ণ পদ রায় আত্মগোপনে রয়েছেন। 

সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামও আত্মগোপনে রয়েছেন। সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন। 

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই। সাবেক আরেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী সৌদিতে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও এখন দেশেই আছেন। 

অন্যদিকে অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি পদোন্নতি পাওয়া ৬৪ জেলার তৎকালীন এসপিদের অনেকেই এখনও চাকরিতে বহাল আছেন। যদিও কাউকে কাউকে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে। তবে এদের কাউকে বরখাস্ত করা হয়নি। 

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ সিভিলিয়ান ফোর্স ২০১৮ সালে রাতের ভোটের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সুপারদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকায় থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই বর্তমানে ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত। ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত এসব কর্মকর্তার অনেকেই ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। সরকার পতনের পর গণহত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ডিআইজি হারুন অর রশীদ, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম আত্মগোপনে। শাহ মিজান শাফিউর রহমান সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় আছেন। আবার অনেককে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হয়েছে। কাউকে কাউকে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে। এসব কর্মকর্তা ভোল পাল্টে পুনরায় বাহিনীতে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছেনÑ এমন তথ্য রয়েছে। 

বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, এসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ এদের মতো অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের কারণে আজ পুলিশের ভাবমূর্তি সংকটের মধ্যে পড়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কয়েক মাস পরও পুলিশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

রাতের ভোটে কে কোন জেলার এসপি ছিলেন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে রাতে ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরার অপকর্মে দেশের ৬৪ জেলার এসপিরা ছিলেন প্রধান ভূমিকায়। ওই নির্বাচনের সময় ঢাকা জেলার এসপি ছিলেন বিসিএস ২০ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা শাহ মিজান শাফিউর রহমান। তিনি পরে অতিরিক্ত ডিআইজি এবং ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ছিলেন পুলিশ সদর দপ্তরেও। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইউনিটে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। 

কুমিল্লা জেলার এসপি ছিলেন একই ব্যাচের সৈয়দ নূরুল ইসলাম। তিনি পরে পদোন্নতি পেয়ে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে প্রাইজ পোস্টিং পেয়েছিলেন। 

চাঁদপুরের এসপি ছিলেন জিয়াদুল কবীর। বহুল আলোচিত হারুন অর রশীদ ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার। নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন মিরাজ উদ্দিন আহমেদ। মোহাম্মদ নুরে আলম মিনা ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার। আনোয়ার খান ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার। বরগুনার পুলিশ সুপার ছিলেন মারুফ হোসেন। 

এ ছাড়া বাগেরহাটে পঙ্কজ চন্দ্র রায়, চুয়াডাঙ্গায় মো. মাহবুবুর রহমান, বগুড়ায় আলী আশরাফ ভূঁইয়া, কক্সবাজারে এবিএম মাসুদ হোসেন, বরিশালে মো. সাইফুল ইসলাম, দিনাজপুরে সৈয়দ আবু সায়েম, ফরিদপুরে মো. জাকির হোসেন খান, ফেনীতে এসএম জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুরে সামসুন্নাহার, গোপালগঞ্জে সাঈদুর রহমান খান, হবিগঞ্জে বিধান ত্রিপুরা ও জয়পুরহাটে মো. রশীদুল হাসান ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচন চলাকালে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন।

একই সময়ে দেলোয়ার হোসেন জামালপুর, মো. মঈনুল হক যশোর, মো. জুবায়েদুর রহমান ঝালকাঠি, মো. হাসানুজ্জামান ঝিনাইদহ, মো. আহমার উজ্জামান খাগড়াছড়ি, এসএম সফিউল্লাহ খুলনা, মাশরুকুর রহমান খালেদ কিশোরগঞ্জ, মো. মেহেদুল করিম কুড়িগ্রাম, এসএম তানভীর আরাফাত কুষ্টিয়া, আ স ম মাহাতাব উদ্দিন লক্ষ্মীপুর, এসএম রশিদুল হক লালমনিরহাট, মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন মাদারীপুর, খান মোহাম্মদ রেজওয়ান মাগুরা, রিফাত রহমান শামিম মানিকগঞ্জ, মোস্তাফিজুর রহমান মেহেরপুর, মো. শাহ জালাল মৌলভীবাজার, মোহাম্মদ জায়েদুল আলম ফুয়াদ মুন্সীগঞ্জ, মো. শাহ আবিদ হোসেন ময়মনসিংহ, মো. ইকবাল হোসেন নওগাঁ, মো. মোক্তার হোসেন ভোলা, জাকির হোসেন মজুমদার বান্দরবন, বিপ্লব বিজয় তালুকদার নাটোর, এটিএম মোজাহেদুল ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়দেব চৌধুরী নেত্রকোণা, মোহাম্মদ আশরাফ নীলফামারী, মো. ইলিয়াছ শরীফ নোয়াখালী, মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন নড়াইল, মো. শেখ রফিকুল ইসলাম পাবনা , মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ পঞ্চগড়, মো. মইনুল হাসান পটুয়াখালী, মোহাম্মদ সালাম কবির পিরোজপুর, আসমা সিদ্দিকা মিলি রাজবাড়ী, মো. শহিদুল্লাহ রাজশাহী, মিজানুর রহমান রংপুর, মোহাম্মদ আলমগীর কবীর রাঙামাটি, মো. সাজ্জাদুর রহমান সাতক্ষীরা, মো. আব্দুল মোমেন শরীয়তপুর, কাজী আশরাফুল আজীম শেরপুর, টুটুল চক্রবর্তী সিরাজগঞ্জ, মো. বরকতউল্লাহ খান সুনামগঞ্জ, মো. মনিরুজ্জামান সিলেট, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ঠাকুরগাঁও এবং সঞ্জিত কুমার রায় টাঙ্গাইল জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।