Image description

বিজ্ঞাপনে চাকরির লোভনীয় অফার। সাপের খোলসের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন। বিদেশে ভালো চাকরি দেয়ার নামে জিম্মি করে টাকা আদায়সহ নানা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত দেশের বেশ কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি। সময় সংবাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার চিত্র।

বিদেশে কাজের স্বপ্নে পাড়ি দিতে চান অনেকে। কিন্তু সেই স্বপ্নের পেছনে কাজ করছে এক অন্ধকার জাল, যেখানে স্বপ্ন বিক্রি হয় কাগজে। সময় সংবাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমনই রিক্রুটিং নেটওয়ার্কের ফাঁদ, যে ফাঁদে পা দিয়ে বিদেশগামীরা হয়েছেন নিঃস্ব।

ফেসবুকে বিদেশে চাকরির লোভনীয় অফারের বিজ্ঞাপন দেখেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফাইজুল-সোনিয়া দম্পতি। তারা তখনও জানতেন না এই বিজ্ঞাপন তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়ের শুরু। রিক্রুটিং এজেন্সি ‘ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল’ দাবি করেছিল, মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকায় সৌদি আরবে ক্লিনার হিসেবে চাকরি দেয়ার। পরিবারের সঞ্চয়, ধার-কর্জ সব মিলিয়ে টাকা জোগাড় করেন তারা। কিন্তু বিদেশে পৌঁছেই শুরু হয় অন্ধকার অধ্যায়।
 
স্বপ্ন পূরণের আশায় বিদেশগামীরা। ছবি: সময় সংবাদ

 

সৌদি পৌঁছানোর পর থেকেই খোঁজ মিলছিল না ফাইজুলের। ফোনেও বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ। সোনিয়া এজেন্সিতে গেলে আরও টাকা দাবি করেন তারা। ঘটনা গড়ায় মামলায়। সোনিয়া যাদের সহযোগিতায় মামলা করেন, তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করে ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশাল।
 
 
ভুক্তভোগী ফাইজুলের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠিয়েছে। চার লাখ টাকা দাবি করেছে। সেগুলো স্ক্রিনশট দিয়ে রেখেছি।’
 
ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশালের এজেন্সিটির স্বত্বাধিকারী মো. মোশাহেদ সোনিয়াকে হুমকি দিয়েছে- এমন একটি ভিডিও এসেছে সময় সংবাদের হাতে। ভিডিওতে মো. মোশাহেদ বলেন, ‘আপু, আপনি কী বলছেন আমি ‍বুঝতে পারছি না।’ এরপরই ভিলেনের মতো হেসে বলেন, ‘দিস ইস ২০২৫’।  
ভিডিওতে সোনিয়াকে হুমকি দিয়ে ভিলেনের মতো হাসেন ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশাল এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. মোশাহেদ। ছবি: ভিডিও থেকে নেয়া

 

প্রতারণার জালে আটকে শুধু ফায়জুল নয়, এমন ভুক্তভোগী আরও অন্তত পাঁচজন। সবাই একই কায়দায় প্রতারিত। এজেন্সির পেছনে পাওয়া যায় ৩টি প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ। ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল, ধানসিঁড়ি ওভারসিস, আর এস এম এন্টারপ্রাইজ। চুক্তি এক জায়গায়, টাকা অন্য জায়গায়, আর ভিসা করানো হয় আরেক নামে, যা এক নিখুঁত প্রতারণার জাল।
বিদেশে চাকরির প্রলোভনে পড়ে নিঃস্ব বহু মানুষ। ছবি: ভিডিও থেকে নেয়া

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল নামেই রিক্রুটিং এজেন্সি। প্রতিষ্ঠানটি বিএমইটি অনুমোদিত নয়, শুধু বায়রার সদস্য। তবুও বিদেশে শ্রমিক পাঠাচ্ছে সহযোগী প্রতিষ্ঠান ধানসিঁড়ি ওভারসিসের মাধ্যমে।
 
ফেসবুকে প্রচারণা, মেসেঞ্জারে যোগাযোগ, তারপর সরাসরি চুক্তি আর টাকা লেনদেন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো ভিসা দেয়া হচ্ছে আরেক প্রতিষ্ঠান এসএম ইন্টারন্যাশনাল থেকে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছে ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল। তারা বলছেন, অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
 
এমন নিন্দনীয় কাজের সঙ্গে জড়িতদের কোনো রকম ছাড় দিতে রাজি নয় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)। সংগঠনটি বলছে, সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করবেন তারা।
 
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘ভুক্তভোগী সরাসরি অভিযোগ করলে আইন অনুযায়ী সরকার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’  
 
 
আইন অনুযায়ী, শুধু বিএমইটি থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত এজেন্সিই বিদেশে কর্মী পাঠাতে পারে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩-এর ধারা ৩১ ও ৩৩ অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া কর্মী প্রেরণ, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা ভুয়া চুক্তি সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইন থাকলেও প্রয়োগের দুর্বলতা, আর ফেসবুকভিত্তিক প্রচারণায় নতুন নতুন প্রতারণার ঘটনা ঘটছে।
 
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসি।’