মাদকসহ হাতেনাতে ধরা পড়লেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামিরা বিচারিক প্রক্রিয়ায় খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে মাদকের যত মামলা হয়, তার ৫৯ শতাংশই শেষ পর্যন্ত আদালতে প্রমাণ করা যায় না। অন্যভাবে বলা যায়, মাদকের ৫৯ শতাংশ মামলায় আসামিদের সাজা হয় না।
ঢাকাসহ দেশের ২৬টি জেলার বিভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মাদকের ৫০০ মামলার রায় পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এর মধ্যে ২৯৬টি মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন। সাজা হয়েছে ২০৪টি মামলায়। অর্থাৎ সাজার হার মাত্র ৪১ শতাংশ।
মাদকের পৃষ্ঠপোষক, আশ্রয়দাতা বা অর্থ জোগানদাতাদের বিষয়ে অভিযোগপত্রে (তদন্ত শেষে আদালতে যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়) কোনো তথ্য থাকে না। এর ফলে মাদকের মামলায় মূল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
যে ৫০০ মামলা প্রথম আলো পর্যালোচনা করেছে, এগুলোর রায় হয়েছে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে। এসব মামলা হয়েছিল ২০০৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদকসহ গ্রেপ্তার হওয়া আসামি বা আসামিদের বাইরে কোনো মামলাতেই (যে ৫০০ মামলার রায় পর্যালোচনা করা হয়েছে) অন্য কাউকে চিহ্নিত করা যায় না। মামলা করার সময় এজাহারে প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়, এর বাইরে তদন্তে নতুন কিছু উঠে আসে না। মাদকের পৃষ্ঠপোষক, আশ্রয়দাতা বা অর্থ জোগানদাতাদের বিষয়ে অভিযোগপত্রে (তদন্ত শেষে আদালতে যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়) কোনো তথ্য থাকে না। এর ফলে মাদকের মামলায় মূল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পরও কেন আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা যায় না, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মামলার রায়ে কী বলা হয়েছে, তা–ও পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। এতে ১৬টি ঘাটতি চিহ্নিত করা গেছে।
এর মধ্যে প্রথম ছয়টি ঘাটতি হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ এজাহার, তদন্তের দুর্বলতা, পাবলিক সাক্ষী বা নিরপেক্ষ সাক্ষী না থাকা (অভিযানে যাওয়া সদস্যদের বাইরের কোনো ব্যক্তি, যিনি ঘটনাটি দেখেছেন), জব্দতালিকা সঠিকভাবে না করা, আদালতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠা (যেমন এজাহারে বলা হলো গোলাপি রঙের ইয়াবা, কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হলো ইয়াবার রং কমলা)।
এর পাশাপাশি মামলা প্রমাণ করতে না পারার ক্ষেত্রে আরও ১০টি ঘাটতি দেখা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য না দেওয়া, আসামির ভুল ঠিকানা যাচাই না করা, এক থানার ঘটনায় অন্য থানায় মামলা, একই কর্মকর্তার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন, জব্দ আলামত আদালতে প্রদর্শন না করা, কোনো সাক্ষী না পাওয়া, মাদক উদ্ধারে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের (কখনো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারী) সাক্ষ্য না দেওয়া, মামলার তদন্তে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তদারকি না থাকা এবং রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি।
এই অনুসন্ধানের কাজটি ২০ মাস ধরে হয়েছে। এ জন্য ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন আদালত থেকে ১ হাজার ৫৭টি রায়ের (মাদকের মামলা) অনুলিপি সংগ্রহ করা হয়। এর পরের দুই মাসে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০০ মামলার রায় পর্যালোচনা করা হয়।
৯২টি মামলায় ‘নিরপেক্ষ সাক্ষী’ হিসেবে আদালতে যাঁদের হাজির করা হয়েছে, তাঁরা বিচারকের সামনে বলেছেন, ঘটনার (মাদক উদ্ধারের) সময় তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না। অর্থাৎ খালাস হওয়া ২৯৬ মামলার মধ্যে ২৩৭টিতেই আসামি খালাস পেয়েছেন নিরপেক্ষ সাক্ষী না পাওয়ায়। এর বাইরে তল্লাশি, এজাহার এবং তদন্তে গলদ পাওয়া গেছে ৪৮টি মামলায়।
আসামি খালাসের বড় কারণ নিরপেক্ষ সাক্ষী না থাকা
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৪৫টি মামলায় আসামিদের খালাস পাওয়ার অন্যতম কারণ বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা যায়নি। অন্যদিকে ৯২টি মামলায় ‘নিরপেক্ষ সাক্ষী’ হিসেবে আদালতে যাঁদের হাজির করা হয়েছে, তাঁরা বিচারকের সামনে বলেছেন, ঘটনার (মাদক উদ্ধারের) সময় তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না। অর্থাৎ খালাস হওয়া ২৯৬ মামলার মধ্যে ২৩৭টিতেই আসামি খালাস পেয়েছেন নিরপেক্ষ সাক্ষী না পাওয়ায়। এর বাইরে তল্লাশি, এজাহার এবং তদন্তে গলদ পাওয়া গেছে ৪৮টি মামলায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের সময়ই যাঁদের সাক্ষী করা হয়, তাঁরা ঘটনার সময় আসলে উপস্থিত থাকেন না। মাদক উদ্ধার অভিযানে যেভাবে তল্লাশি করার কথা, সেটিও হয় না। জব্দতালিকার বিবরণ ও এজাহারে অসংগতি থাকে। শুরুর গলদের কারণে গ্রেপ্তার আসামিদের বিচার শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায় না। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই নওগাঁর বদলগাছী থানায় মাদক উদ্ধারের ঘটনায় একটি মামলা হয়। গ্রেপ্তার হন একজন। এ মামলার রায় হয় ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট। রায়ে আসামি খালাস পান। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মাদক উদ্ধারের ঘটনায় নিরপেক্ষ সাক্ষী হিসেবে যে দুজনকে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে হাজির করেছিল, তাঁরা ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।
পুলিশ সদর দপ্তর ২০২৪ সালে ‘ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীর অনুপস্থিতি: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছে। সেখানে মাদক মামলার ভুয়া সাক্ষীর বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, পাঁচটি মাদক মামলায় সাক্ষী হয়েছিলেন এক ব্যক্তি। যদিও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মামলাগুলো হয়েছিল। তিনি কখনোই মাদক উদ্ধারের সময় উপস্থিত ছিলেন না।
ওই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাদক উদ্ধারের পাঁচ মামলায় এক ব্যক্তির সাক্ষী হওয়ার ঘটনাটি সিলেট অঞ্চলের। ওই ব্যক্তি মূলত পুলিশের সোর্স (তথ্যদাতা)। কোনো মামলায় সাক্ষীর প্রয়োজন হলেই তাঁকে ফোন করা হতো। তিনি গিয়ে জব্দতালিকার কাগজে স্বাক্ষর করতেন।
কাগজে-কলমে দেশে মাদক প্রতিরোধের কাজটি করে সরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযান চালায় পুলিশ। এই দুই সংস্থার বাইরে র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডও মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। বিশেষ পরিস্থিতি এবং পার্বত্য এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। তবে মাদক মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশ।
মাদকের পৃষ্ঠপোষকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন বলে উল্লেখ করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) আশিক সাঈদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর চিন্তাভাবনা করছে। মাদকের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনার জন্য মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রতি সদর দপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে।
ধরা পড়ে লাল রঙের ইয়াবা, পরে হয়ে যায় কমলা
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নড়াইলের আদালত একটি মামলার রায়ে বলেছেন, জব্দতালিকায় উল্লেখ রয়েছে ইয়াবার রং হালকা গোলাপি। কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে এসেছে ইয়াবার রং কমলা। এর অর্থ হচ্ছে, উদ্ধারকৃত আলামত ও পরীক্ষাগারে পাঠানো আলামত এক নয়। এই মামলা ছিল ৩০টি ইয়াবা উদ্ধারসংক্রান্ত একটি মামলা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার একটি আদালত ইয়াবা উদ্ধারসংক্রান্ত মামলার রায়ে বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঁচটি ইয়াবা পাঠানোর কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে এসেছে দুটি ইয়াবা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। রাসায়নিক প্রতিবেদনে সংখ্যাগত অসংগতি ও অস্পষ্টতা রয়েছে। এতে সন্দেহ তৈরি হয়, জব্দ করা ইয়াবাগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল কি না। এ মামলাতেও সব আসামি খালাস পান।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এসেছে, তদন্ত কর্মকর্তার ভুলে ও গাফিলতির কারণে অনেক মামলা আদালতে প্রমাণ করা যায় না। শুধু রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনের কারণে মাদক উদ্ধারের ২৩টি মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছেন।
অন্যদিকে নেত্রকোনায় হেরোইন উদ্ধারের একটি মামলায় দেখা যায়, তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন জমাই দেননি। এ মামলার রায় হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এবং সব আসামি খালাস পান।
মাদকসংক্রান্ত মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে রাসায়ানিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এর কারণ হচ্ছে, উদ্ধার করা আলমত আসলেই মাদক কি না এবং মাদক হলে সেটি কোন ধরনের মাদক, তা বের করার বৈজ্ঞানিক উপায় হচ্ছে রাসায়নিক পরীক্ষা করা। এই পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে হয় তদন্ত কর্মকর্তাকে। এ ছাড়া রাসায়নিক পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে একেক মাদকের (উদ্ধার হওয়া) জন্য একেক রকমের শাস্তির বিধান রয়েছে।
দেশে গত পাঁচ বছরে যত মামলা হয়েছে, এর ৩৮ শতাংশই মাদকসংক্রান্ত মামলা। মাদক মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
সাক্ষ্য দেন না কর্মকর্তারা
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, যে ২৯৬টি মামলা আদালতে প্রমাণ করা যায়নি, তার মধ্যে ১২৬টিতে আদালতে তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেননি। বাদী সাক্ষ্য দেননি ৭৯টি মামলায়। তদন্ত কর্মকর্তা এবং বাদী—এই দুজনের কেউই সাক্ষ্য দেননি, এমন মামলার সংখ্যা ৬৬। এ ছাড়া অভিযানকারী দলের অন্য সদস্যরা (বাদী ছাড়া) সাক্ষ্য দেননি ৯৭টি মামলায়।
এ ছাড়া অভিযানকারী দলের সদস্যদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে ৫৫টি মামলায় আসামি খালাস হয়েছেন। এমনকি ২৯টি মামলায় কোনো সাক্ষীই আদালতে হাজির করা যায়নি।
খালাস হওয়া বিভিন্ন মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা এবং অভিযানকারী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে বারবার সমন জারি করেও আদালতে আনা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে আসামিদের খালাস না দিয়ে উপায় থাকে না। আবার অভিযানকারী দলের সদস্যদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে মাদক উদ্ধার অভিযান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। এসব ক্ষেত্রেও আসামিদের জন্য সুযোগ তৈরি হয়। এসব বিষয় আসামিদের পক্ষে যায়।
২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার বারিধারা থেকে পাঁচ গ্রাম আইস (বিশেষ ধরনের মাদক) জব্দের ঘটনায় মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ মামলার রায় হয় ২০২৩ সালের আগস্টে। রায়ে একমাত্র আসামি খালাস পান। এই মামলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাঁচজন কর্মকর্তা সাক্ষী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাসহ তিনজন সাক্ষ্য দেননি।
যে আসামি খালাস পেয়েছেন, তাঁর বিষয়ে ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, মিয়ানমার থেকে আসা ভয়ংকর মাদক আইস ছড়িয়ে দেওয়া একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য তিনি।
প্রথম আলোর পর্যালোচনায় আসা তথ্য উল্লেখ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে বক্তব্য চাওয়া হয়। সংস্থাটি লিখিতভাবে জানায়, দায়সারা এজাহার বা তদন্তের কারণে যেসব মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন, সেসব মামলার রায়ের কপি আদালত থেকে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারও গাফিলতির তথ্য পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাদক মামলার এজাহার হয় দায়সারা, তদন্তও হয় যেনতেন। বছরের পর বছর এই অবস্থা চলছে। যে কারণে মূল আসামিরা বিচারের আওতায় আসে না। এই প্রবণতা থেকে বের হতে না পারলে দেশে মাদকের বিস্তার রোধ করা কখনোই সম্ভব হবে না।সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা শাহ আলম
মোট মামলার ৩৮% মাদকসংক্রান্ত
পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৯ লাখ ৫৭ হাজার ১০৭টি। এর মধ্যে মাদক মামলা হয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৮০৯টি। অর্থাৎ দেশে গত পাঁচ বছরে যত মামলা হয়েছে, এর ৩৮ শতাংশই মাদকসংক্রান্ত মামলা। মাদক মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি হয় মাদকসংক্রান্ত অপরাধের মামলা। সংখ্যার হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মামলা হয় নারী ও শিশু নির্যাতনকেন্দ্রিক ঘটনায়, যা মোট মামলার ১০ শতাংশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি নিয়মিত (মাসিক) প্রকাশনা হচ্ছে ডিটেকটিভ। ২০১৬ সালের পুলিশ সপ্তাহে ডিটেকটিভ–এর বিশেষ সংখ্যা বের হয়। সেখানে ‘মাদক অর্থায়ন ও মাদক মামলার তদন্ত’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম। অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হয়ে গত বছরের অক্টোবরে তিনি অবসরে যান।
ওই নিবন্ধে বলা হয়, মাদকসেবী, মাদকের বাহক বা খুচরা বিক্রেতাকে ধরে মামলার এজাহার দায়ের করা হয়। অথচ এর পরিবেশক, স্থানীয় গডফাদার, আশ্রয়দাতা, অর্থ জোগানদাতা, সহযোগী ও সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালানে সহায়তাকারী কাউকেই চিহ্নিত করা হয় না। মামলার তদন্ত হয় দায়সারাভাবে এবং তদন্তের সময় কোনো তদারক করা হয় না।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, মাদক মামলার এজাহার হয় দায়সারা, তদন্তও হয় যেনতেন। বছরের পর বছর এই অবস্থা চলছে। যে কারণে মূল আসামিরা বিচারের আওতায় আসে না। এই প্রবণতা থেকে বের হতে না পারলে দেশে মাদকের বিস্তার রোধ করা কখনোই সম্ভব হবে না।
ত্রুটিপূর্ণ ‘সাকসেস ইন্ডিকেটর’
মাদক জব্দের মামলার তদন্তের ঘাটতির বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের মাঠপর্যায়ের ২০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে প্রশ্ন ছিল, মাদকের মতো সংঘবদ্ধ অপরাধের তদন্ত কেন দায়সারা হয়।
এর উত্তরে ওই কর্মকর্তাদের (নাম ও পদবি প্রকাশ করতে চাননি) সবাই বলেছেন, তাঁদের কার্যক্রমের সফলতা মূলত নির্ধারণ করা হয় মাদক জব্দের পরিমাণ এবং এ–সংক্রান্ত মামলার সংখ্যার ওপর। তদন্তের বিষয়টিকে নিয়মিত কাজ হিসেবেই দেখা হয়, এর জন্য (তদন্ত) কোনো পুরস্কার বা তিরস্কারের ব্যবস্থা নেই। ফলে মাদক উদ্ধারের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তদন্তের বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায় না। একই কারণে অনেক কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ দেখান না।
এই ২০ কর্মকর্তার বক্তব্য যেন ২০১৬ সালের পুলিশ সপ্তাহে প্রকাশিত বিশেষ ডিটেকটিভ–এ তৎকালীন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলমের প্রবন্ধে উঠে আসা অভিমতের অনুরূপ। সেই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, মাদক প্রতিরোধে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর ‘সাকসেস ইন্ডিকেটর’ (সফলতার মাপকাঠি) হাস্যকরভাবে দুর্বল এবং লক্ষ্যহীন। নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে যে মাপকাঠি দিয়ে সংস্থা বা ব্যক্তির পারফরম্যান্স (দক্ষতা) যাচাই করা হয়, তা দিয়ে মাদক পরিস্থিতির উন্নতি বা অবনতি বোঝা প্রায় অসম্ভব। মাঠপর্যায়ের পুলিশকে বছরের শেষে সাফল্যের ক্রেস্ট উপহার দেওয়া হয়, যা নির্ধারিত হয় দায়ের করা মামলার সংখ্যা, উদ্ধারকৃত মাদকের পরিমাণ এবং সংক্ষিপ্ত বিচারে আসামির সাজার হার দেখে।
শুধু উদ্ধার অভিযানকে গুরুত্ব দেওয়ার উদাহরণ হিসেবে যাত্রাবাড়ী থানার একটি মাদক মামলার কথা বলা যায়। মামলাটি হয়েছিল ২০২০ সালের ১৩ জুলাই। এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, তিনজনকে ৭ হাজার ২০০টি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা আরও পাঁচজনের নাম বলেছিলেন। তবে অভিযোগপত্রে চারজনের নাম বাদ দেওয়া হয়। কারণ, পলাতক আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা যায়নি। এ মামলার বিচার এখনো চলছে।
দেশে মাদকের বিস্তার
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত বছর ২ কোটি ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫১টি ইয়াবা ধরা পড়েছে। এর আগের বছর (২০২৩ সাল) ৪ কোটি ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ২২৯টি ইয়াবা বড়ি জব্দ করেছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা। ইয়াবার পাশাপাশি গত বছর বিভিন্ন অভিযানে ৫০৩ কেজি হেরোইন, ১৩০ কেজি কোকেন, ৫ লাখ ৭২ হাজার ৮৬৫ বোতল ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশি ব্যবস্থা ভঙ্গুর থাকায় গত বছরের জুলাইয়ের পর থেকে দেশে মাদক উদ্ধারে সে অর্থে বড় কোনো অভিযান হয়নি। দীর্ঘ সময় পুলিশের তল্লাশিও সেভাবে ছিল না। যে কারণে মাদক উদ্ধারের পরিমাণ কমে গেছে। এর অর্থ এই নয় যে দেশে মাদক চোরাচালান কমেছে। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির মতে, যত মাদক বিক্রি হয়, ধরা পড়ে তার মাত্র ১০ শতাংশ।
অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে এখন মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৮৩ লাখ। তাঁদের বেশির ভাগ পুরুষ। নারী ও শিশুদের মধ্যেও মাদকাসক্তি রয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষা করেছিল, সেখানে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ৩৬ লাখ।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা)। আর মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী প্রথম আলোকে বলেন, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত গডফাদারদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকে। এমনও দেখা গেছে, মাদকের গডফাদার ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতা। তাঁদের সঙ্গে পুলিশ–প্রশাসনের সখ্য থাকে, যোগসাজশ থাকে। রাজনৈতিক দল–সংশ্লিষ্ট গডফাদারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে দেশের মাদক পরিস্থিতির উন্নতি অসম্ভব।
বছরের পর বছর ধরে মাদকের মতো সংঘবদ্ধ অপরাধের দুর্বল এবং দায়সারা তদন্ত করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। এর ফলে বড় অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয় না। মাদকসহ গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করতে না পারার অর্থ হচ্ছে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা একেবারেই উদাসীন।গবেষক ও মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক
মাদক মামলার তদন্ত কেমন হওয়া উচিত
মাদক জব্দের ঘটনায় করা মামলার তদন্তে কর্মকর্তাদের করণীয় কী হবে, সে বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। এর আগে ২০২০ সালের ৩০ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশও (ডিএমপি) একই ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিল। দুটি নির্দেশনাতেই সেখানে মাদক জব্দের যেকোনো ঘটনায় পুরো চক্র চিহ্নিত করার পাশাপাশি অর্থপ্রবাহ খুঁজে বের করার কথা উল্লেখ ছিল।
ওই দুই নির্দেশনার পর ডিএমপির আওতাধীন এলাকার ২০টি মাদক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এসব মামলা এখন বিচার পর্যায়ে আছে।
মাদক মামলার তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপির নির্দেশনা মেনে তদন্ত প্রতিবেদন (অভিযোগপত্র) জমা হয়নি। শুধু বাহককে আসামি করেই তদন্ত শেষ করা হয়েছে। একটি তদন্ত প্রতিবেদনেও চক্রকে চিহ্নিত করা হয়নি, মাদক কোথা থেকে এল, গন্তব্য কোথায় ছিল—এসবের কিছুই বের যায়নি।
উদাহরণ হিসেবে পল্টন থানার একটি মামলার কথা উল্লেখ করা যায়। ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর পল্টন থানা–পুলিশ ৮০০ ইয়াবাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে একটি মামলা দেয়। তবে আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে ওই দুজন ছাড়া অন্য কাউকে আসামি করা হয়নি। এই মামলার এজাহারের বক্তব্য ও তদন্ত শেষে অভিযোগপত্রের তথ্য প্রায় একই।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন পল্টন থানার তৎকালীন এসআই রায়হান কবির। এখন রংপুরে কর্মরত। মাদকের ওই মামলার তদন্তের বিষয়ে গত সোমবার (৩ নভেম্বর) রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এত আগের ঘটনা তাঁর মনে নেই।
মাদক মামলার তদন্ত যাতে যথাযথভাবে হয়, সে বিষয়ে সরকারের দিক থেকে কঠোর বার্তা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ যাতে বিচারপ্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয় থাকে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষক ও মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে মাদকের মতো সংঘবদ্ধ অপরাধের দুর্বল এবং দায়সারা তদন্ত করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। এর ফলে বড় অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয় না। মাদকসহ গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করতে না পারার অর্থ হচ্ছে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা একেবারেই উদাসীন।