Image description

বাংলাদেশকে ব্যবহার করে চীনবিরোধী কার্যক্রম চালানোর জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একটি সংগঠিত নেটওয়ার্ক কাজ করছে বলে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। এতে দেখা যায়, এ নেটওয়ার্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামের সংগঠনের কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।

বাংলাদেশের মানুষ চীনের উইঘুরের মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল। উইঘুরের মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদও করেছেন তারা। ভারতীয় ‘র’-এর পরামর্শে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর থেকে উইঘুর মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতির নামে চীনের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। এ কার্যক্রমে বিপুল অর্থায়ন আসে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর পক্ষ থেকে। আগামী বুধবার দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের কর্মসূচি পালনের গোপন তৎপরতা চালানোর টার্গেট রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনবিরোধী এ প্রচারণার সঙ্গে সরাসরি জড়িত চারজন। তারা হলেন- ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী, খেলাফত আন্দোলনের সাবেক আমীর-ই-শরীয়ত মাওলানা আবু জাফর কাসেমী এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন।

তাদের মধ্যে তিনজনই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানের নাম উঠে এসেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে আবদুল্লাহ আল মামুন জেলে রয়েছেন।

এ প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি না থাকায় কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী আমার দেশকে জানান, এক দেশের নাগরিক হয়ে অন্য দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা অপরাধ। এতে দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে আস্থার সংকট তৈরি হয়। এসব কাজ দেশদ্রোহের শামিল।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর চীনবিরোধী কার্যক্রম আরো জোরদার হয়। বর্তমানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সংশ্লিষ্টদের ওপর কড়া নজর রাখছে।

সংগঠনের উত্থান ও চীনবিরোধী প্রচারণা

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ গঠন করেন। ওই বছরের মার্চে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পদবঞ্চিত নেতা আমিনুল ইসলামকে সভাপতি এবং ছাত্রলীগ নেতা আল মামুনকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা গঠন করা হয়। শুরুতে তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা ইস্যুতে সক্রিয় থাকলেও পরবর্তী সময়ে ভারতীয় মদতে উইঘুর মুসলমানদের সমর্থনের নামে মাঠে কর্মসূচি নিয়ে নামে।

২০২০ সাল থেকে উইঘুরদের সমর্থনে ঢাকায় একের পর এক সমাবেশ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করলেও তাদের উদ্দেশ্য চীনের বিরুদ্ধে মানুষকে খ্যাপিয়ে তোলা এবং ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক নষ্ট করা। এসব আয়োজনের পেছনে ছিল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও এর সহযোগী ছাত্র সংগঠনগুলো। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী ওলামা লীগের নেতা মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী এবং সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবু জাফর কাসেমীও এ তৎপরতায় যুক্ত হন। ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের নেতৃত্বে বহু অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর আওয়ামী ওলামা লীগ এবং ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ কর্মসূচিতে মূল আয়োজক হিসেবে কাজ করে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। এসব অনুষ্ঠানে হাতেগোনা কয়েকজন উপস্থিত হলেও ভারতীয় গণমাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়।

চীনা দূতাবাস সে সময় এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর ২০২৩ সালের মে মাসে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নৈতিক ও সাংগঠনিক অসঙ্গতির দায়ে বহিষ্কার করা হয়। তবে বিস্ময়কর বিষয় হলোÑযে বছর আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও আল মামুন বহিষ্কৃত হন, সেই বছরই চীনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কার্যক্রম দেখা যায়।

সেই সময় থেকে সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোট, আওয়ামী ওলামা লীগ এবং তাদের সহযোগী সংগঠন ‘বাংলাদেশ সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট ফোরাম’ (বিএসএএফ) আয়োজকের দায়িত্ব নেয়। এ সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, পঞ্চগড় ও যশোরে ছোট পরিসরে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ২৫-৩৫ জন। এদের মধ্যে অনেকেই অর্থের বিনিময়ে অংশ নিত বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মাসুম বিল্লাহ ২০২১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, মাওলানা আবু জাফর কাসেমী সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তৎকালীন নেতৃত্ব অপসারণের পর এ দুই ব্যক্তি আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় উইঘুর মুসলমানদের সমর্থনে মিছিল, সমাবেশ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পরিচালনা করেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রতিটি কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন মাওলানা আবু জাফর কাসেমী।

ভারত সফর ও রাজনৈতিক যোগাযোগ

২০২৩ সালে বিএসএএফের কয়েকজন নেতা ভারত সফর করে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সফরের আয়োজন করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সঙ্গে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের আবু জাফর কাসেমী চীন ইস্যুতে অন্যতম সক্রিয় বক্তা ছিলেন। ভারতের দেওবন্দ মাদরাসায় পড়াশোনা করা এ নেতা দীর্ঘদিন ভারতে অবস্থান করেছেন। অন্যদিকে, ওলামা লীগের সদস্যসচিব মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ীও আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপকমিটির সদস্য এবং বিএসএএফের প্রধান সমন্বয়ক ও সভাপতি। তিনিও বিজেপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি হওয়ায় স্থানীয় লোকজন দিয়ে নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য জেলায় নিয়মিত চীন বিরোধী কর্মসূচি আয়োজন করতেন।

তিন ধাপে কার্যক্রম

প্রতিবেদনে সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এ চক্রের তৎপরতা তিন ধাপে পরিচালিত হয়। প্রথম ধাপে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতৃত্বে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ; দ্বিতীয় ধাপে সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোট ও ওলামা লীগের সম্পৃক্ততা; তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশ সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট ফোরামের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ভারত সফর। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে চীনবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে।

প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টদের প্রোফাইল

আমিনুল ইসলাম বুলবুল

গোপালগঞ্জের বাসিন্দা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি ছিলেন। ২০২৩ সালে নৈতিক ও সাংগঠনিক অসঙ্গতির অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ থেকে আজীবন বহিষ্কার হন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ভারতে পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে সামাজিকমাধ্যমে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি র-এর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন।

আবদুল্লাহ আল মামুন

গাইবান্ধার বাসিন্দা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পদবঞ্চিত মামুন কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় গঠিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক হন। পরে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার এপিএস হিসেবেও কাজ করেছেন মামুন।

মাওলানা আবু জাফর কাসেমী

ভারতের দেওবন্দ মাদরাসার সাবেক শিক্ষার্থী ও সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান। তিনি খেলাফত আন্দোলনের সাবেক নেতা। তিনি ঢাকার একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। চীনের উইঘুর সমর্থনমূলক সভা, সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভের মাধ্যমে জনমত গঠন করার চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী

সন্দ্বীপের বাসিন্দা, আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এবং বিএসএএফের প্রধান। ধর্মীয় ও সামাজিক ইস্যুতে সক্রিয় থেকে চীন বিরোধী নিয়মিত কর্মসূচি আয়োজন করেছেন। বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও তার একাধিক বৈঠকের তথ্য পাওয়া গেছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও তার নিবিড় যোগাযোগ আছে।

এসবির প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে চীনবিরোধী আন্দোলনের জন্য গড়ে ওঠা এ নেটওয়ার্ক মূলত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনাতেই পরিচালিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ থেকে শুরু করে ওলামা লীগ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে তারা দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিকভাবে এ তৎপরতা চালিয়ে এসেছে। সরকারের পরিবর্তনের পর তাদের কার্যক্রম আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যা বর্তমানে নিরাপত্তা সংস্থার কঠোর নজরদারিতে রয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য

প্রতিবেদনে যে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন কারাগারে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। প্রচারণার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাওলানা আবু জাফর কাসেমী জানান, আমি চীনের বিরুদ্ধে প্রচারণার সঙ্গে জড়িত নই। উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছি। তিনি ভারতের দেওবন্দ মাদরাসায় লেখাপড়া করেছেন বলে জানান।

আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী এ বিষয়ে জানান, আমি কোনো চীন বিরোধী প্রচারণার সঙ্গে জড়িত নই। তবে তার ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চাইলে তিনি অসংলগ্ন কথা বলেন।