Image description
 

Md Saidul Islam(মোঃ সাইদুল ইসলাম)


এক.
বর্তমান বিশ্বে ইসলামী জ্ঞান জগতে মাওলানা আবুল আ'লা মওদূদী (র:) ইমাম, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দায়ী ইলাল্লাহ, বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, ইসলামি রাজনৈতিক দর্শনের আধুনিক রূপকার, সুদবিহীন ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জনক, গত একশ বছরে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামি স্কলার, ইত্যাদি নানান নাম ও খেতাবে পরিচিত। উনার চিন্তা-দর্শনের উপর অক্সফোর্ড সহ দুনিয়ায় সেরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত শতাধিক পিএইচডি গবেষণা হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে কিছু "অশিক্ষিত" আলেম উনাকে নিয়ে অনেক মুখরোচক ফালতু অপপ্রচার করে নিজেদেরকে জালেম এবং হাস্যকর হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। "অশিক্ষিত" এজন্য বললাম, যে উনারা মাওলানা মওদূদীর সাহিত্যভান্ডার সরাসরি অধ্যয়ন না করে বরং টাকা, ক্ষমতা, এবং আধিপত্যের লোভে পড়ে "শোনা কথার" উপর ভিত্তি করে এই চরম জুলুম করেছেন, এবং এখনো করে চলেছেন।
হাদিসের ভাষ্য অনুসারে কারোর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়াটা হত্যা থেকেও জঘন্য কাজ। মাওলানার চিন্তা দর্শনকে আমরা একাডেমিক পর্যালোচনা করতে পারি, সেগুলোর সাথে দ্বিমতও পোষণ করতে পারি, কিন্তু মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ঘৃণার চাষ করা কোন মুসলমানের কাজ হতে পারে না।
 
দুই.
"মওদূদীবাদ নিয়ে অসংখ্য বই প্রকাশের অন্তরালে" কি আছে, সেটা নিয়ে একটা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ হাজির করেছেন বিশিষ্ট লেখক জনাব নজরুল ইসলাম টিপু। উনার বিশ্লেষণটা আমি হুবহু তুলে ধরছি:
"ফিতনায়ে মওদূদী" ১৯৬২ সালে উর্দু ভাষায় প্রথম রচিত গ্রন্থ! লিখেছিলেন আল্লামা আব্দুল কাইয়ুম পেশোয়ারী (রহঃ)। এই বইটির কোন অনুলিপি বর্তমান বাজারে পাওয়া যায় না কিন্তু বইটি মাদার কপি হিসেবে প্রকাশনা জগতে অনুঘটক হয়ে আছে।
কৌতূহলের বিষয় হল, বাংলা ভাষায় মাওলানা মওদূদী (রহঃ) এর বিরুদ্ধে যত বই লিখিত হয়েছে, তাদের সবগুলোর Mother Book হল পেশোয়ারী সাহেবের উপরের গ্রন্থটি! সমালোচকেরা যারা মওদুদী (রহ) বিরুদ্ধে বই লিখেছেন, তাদের কোন লেখকই, নিজ থেকে মওদূদীর (রহ) সে সব বই পড়েন নাই। তাদের বিশ্বাস ও ভক্তির মানদণ্ডই ছিল, পেশোয়ারী সাহেব তথা আকাবির কি মিথ্যা লিখবেন নাকি? এটাই ছিল এসব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতার মূল মানদণ্ড।
 
প্রশ্ন হল, বইটির বাংলা ভাষার অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তা হল কেন? চলুন সেই প্যাঁচের জটলা খুলি।
১৯৬১ সালে আইয়ুব খান 'মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ' চালু করেন। এর বিরুদ্ধে সমগ্র পাকিস্তানের আলেম সমাজ গর্জে উঠেন। লিখনি, বক্তব্য, বক্তৃতা, প্রচার ও রাজনৈতিক কাজের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী সোচ্চার ছিলেন, মাওলানা মওদূদী (রহঃ)। যার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ঠা জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীকে আইয়ুব খান ব্যান করেন।
জামায়াতকে ব্যান করার আগে আইয়ুব খান, পেশোয়ারী (রহ) সাহেবের বইটি সরকারী ভাবে বিতরণ করেন কিন্তু সেটি তো উর্দু ভাষায় লিখিত। তাই বাংলা অঞ্চলেও এই বইয়ের প্রচার করার দরকার হয়ে পড়ে। তাছাড়া আইয়ুব খান জমিয়তে মুদার্রেসিনের মাধ্যমে সরকারী ধারার মাদ্রাসা ও আলেমদের একটি প্লাটফর্মে এনে, তার সরকারের নীতি তথা মুসলিম পারিবারিক আইনের পক্ষে আনার জন্যে কিছু আলেম শ্রেণীকে একত্রিত করেন। তিনি মাদ্রাসা গুলোকে সরকারী ভাবে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে একাজে এগিয়ে যাবার ফন্দি বের করেন।
১৯৬২ সালের ২৮শে অক্টোবর বাঙ্গালী মোনায়েম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন। তিনি তদানীন্তন জামানার সেরা বিদ্যাপীঠ শর্ষীনা আলীয়া মাদ্রাসা পরিদর্শনে গেলে পর, মাদ্রাসার জন্যে বিরাট সরকারী অনুদান প্রদান করেন। মোনায়েম খান তখন মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল জনাব আজিজুর রহমান কায়েদ (রহ) সাহেবকে মওদূদী (রহ) সরকার বিরোধী বিভ্রান্তি নিয়ে একটি বই লিখার জন্যে অনুরোধ করেন।
প্রিন্সিপ্যাল কায়েদ সাহেব জানান, তিনি কিভাবে এমন বই লিখবেন! যেহেতু তার কাছে ওই বিষয়ে তথ্যজ্ঞান নাই। তখনই গভর্নর মোনায়েম খান পরামর্শ দেন যে, মওদূদী (রহ) বিষয়ে অত গবেষণার দরকার নেই। আবদুল কাইয়ুম পেশোয়ারী (রহ) কর্তৃক লিখিত 'ফিতনায়ে মওদূদী" বইটিকে হুবহু বাংলায় অনুবাদ করে দিলেই হবে।
অত আগ-পাছ চিন্তা না করেই, আজিজুর রহমান কায়েদ (রহ) "মওদূদী জামায়াতের স্বরূপ" নামে বইটি প্রকাশ করেন! এটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রথম বই। সেটার প্রকাশ কাল জানা না গেলেও, বইটি আইয়ুব খানের পুরো আমলে বেশী প্রচারিত হয়। ধারণা করা হয় ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে বাংলা বইটি বাজারে আসে।
বর্তমান বাজারে "মওদূদী-জামাত ফেৎনার স্বরূপ" লেখক আনোয়ার কবিরের যে সংকলন টি বাজারে পাওয়া যায়, সেটার পিছনেও রাষ্ট্রীয় উৎসাহ ছিল। লেখক আনোয়ার কবির অতি উৎসাহী হয়ে, আগের বইটিকে পরিমার্জন করে নতুন সংকলন হিসেবে বাজারে ছাড়ে। ১৯৯৫ সালের দ্বিতীয় সংস্করণের গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে নাস্তিক লেখক শওকত ওসমান এই বইয়ের প্রধান আলোচক ছিলেন। একজন চরম নাস্তিক ইসলাম বিষয়ে, গভীর আলোচনা করে, বাংলাদেশে বইটির প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব বর্ণনা করেন। পরবর্তীতে হাসিনা সরকার আরো উৎসাহী হয়ে, ইসলামী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বইটিকে সবার হাতে হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন এবং কবির সাহেব সম্মানীত হন!
 
১৯৭৫ সালের দিকে "ফিতনা-এ-মাওদূদিয়াত" নামে শাইখ মুহাম্মাদ যাকারিয়্যা (রহ) উর্দুতে আরেকটি বই লিখেন। এটি মূলত পেশোয়ারী সাহেবের বইয়ের অতিরিক্ত সংযোজিত ভার্সন। এই দুটিকে মিলিয়ে সংকলন করেছেন, বাঙ্গালী লেখক আনোয়ার কবির। তার এই বই লেখার উদ্দেশ্য ছিল আইন-আদালতের মাধ্যমে জামায়াতকে কাবু করার মত কিছু সরস ম্যাটেরিয়াল যোগাড় করে দেওয়া কিন্তু অদ্যাবধি আদালতে এগুলো কোন কাজে আসেনি।
 
এছাড়া বাংলা ভাষায় আরো অনেকগুলো বই রচিত হয়েছে। এগুলো সবই উপরের মূল গ্রন্থের ছেলে, নাতি, পুতি ধরনের। উপাত্ত সেই একটা গ্রন্থই। মওদূদী (রহ) যেভাবে আইয়ুব খান, মুসলিম লীগ, আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি, কমিউনিস্ট ও রাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিশেধাগারের মুখে পড়েছে। সেভাবে আবার ওহাবী, সুন্নি, আহলে হাদিস, সালাফী, দরবারী, তাবলীগ, দেওবন্দী, কাদিয়ানী, দরগাহ, পীর-পন্থি সিলসিলার সবার আক্রমণের মুখে থেকেছে।
 
ওসব নানা ফিরকা পন্থিরাও ওদের মত করে একই উপাত্ত দিয়ে আরো বই লিখেছে, প্রচার করেছে। সে সব বই থেকে ওয়াজ, নসিহত, আলোচনা, সমালোচনা, মহাসম্মেলন হয়েছে-হচ্ছে। তাই বাংলা ভাষায় এত বইয়ের সমাহার কিন্তু সব বইয়ের উৎস সেই একটাই, যেটা পেশোয়ারী (রহ) সাহেব লিখে গেছেন। ইতিহাসে এটা এক বিরল দৃষ্টান্ত! এত ঝড়-ঝাপট মোকাবেলা করে কিভাবে ঠিকে আছে, মওদূদীর দর্শন ও মতবাদ। এটা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। আবার একজনের সমালোচনায় এত বই সম্ভবত খুব কম সংখ্যক মানুষের বেলায় লিখিত হয়েছে!
 
তিন.
আমার সাথে ছবিতে যাকে দেখছেন, তিনি হলেন প্রফেসর ড. সানো মুস্তাফা কুতুব। বর্তমানে সৌদি আরবের জেদ্দাভিত্তিক ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (OIC)-এর আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফিকহ্ অ্যাকাডেমির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, যেখানে তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে তরুণ অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে উপ-উপাচার্য (ডেপুটি রেক্টর)। এছাড়া তিনি গিনি কনাক্রিতে টানা ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ড. সানো আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। উনার কাছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ায় আমি "ফিকহ আল ইবাদাহ" কোর্সটি করেছি। একজন জগদ্বিখ্যাত ফকীহ হয়েও ড. সানো মাওলানা মওদূদীর একজন ক্ষুদ্র ছাত্র হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন।