দেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বেসরকারি স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিরা সমাজসেবার উদ্দেশ্য নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান এখন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিস্বার্থ ও পারিবারিক প্রভাবের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে বেড়েছে নিয়োগ বাণিজ্য, আর্থিক অনিয়ম, প্রশাসনিক দুর্বলতা, হয়েছে শিক্ষার মানের অবনতি।
প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ম্যানেজিং কমিটিতে সভাপতি হওয়ার বিধান এখনও বহাল রয়েছে। ফলে অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে চান বা হয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা হাতে গোনা। এই সংখ্যা খুব একটা চিন্তার নয়। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিরা যেন অনিয়ম করতে না পারেন সেজন্য কমিটি গঠন সংক্রান্ত নীতিমালায় আমূল পরিবর্তন এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এই নীতিমালা বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করছে একটি পক্ষ বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ম্যানেজিং কমিটিতে যারা রয়েছেন, তাদের কারণে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে শুনিনি। তবে অনিয়ম রোধে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। ম্যানেজিং কমিটি গঠন সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে সব অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে।’
প্রতিষ্ঠানটা যিনি বানিয়েছেন, তিনি সেটাকে নিজের সম্পত্তি মনে করেন। শিক্ষক নিয়োগ দিতে চান নিজের মতো করে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়—হাবিবুর রহমান খোকন, শিক্ষক, বগুড়া সদর উপজেলার স্কুল।
জানা যায়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতারা ব্যক্তিগত জমি দিয়ে থাকেন। শুরুতে প্রতিষ্ঠাতা বা তার পরিবার সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর জন্য জমি দান করন, নিজ উদ্যোগে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে সংগ্রহ করেন চেয়ার-টেবিল ও পাঠদান উপকরণ। শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে নিজেরাই দেন অর্থ, সময় ও শ্রম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমাজসেবার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে জায়গা করে নেয় ব্যক্তিস্বার্থ। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠাতা নিজেই ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পদটি ধরে রাখেন বছরের পর বছর। তার প্রভাবেই শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্যন্ত সব সিদ্ধান্ত চলে তার কথাতেই।
অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের একাধিক সদস্য শিক্ষক বা কর্মকর্তা পদে কর্মরত থাকেন। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত পারিবারিক মালিকানায় রূপ নেয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে অনেক যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হন, আর অযোগ্যদের মাধ্যমে শিক্ষার মান নেমে যায় তলানীতে।
বগুড়া সদর উপজেলার স্কুল শিক্ষক হাবিবুর রহমান খোকন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটা যিনি বানিয়েছেন, তিনি সেটাকে নিজের সম্পত্তি মনে করেন। শিক্ষক নিয়োগ দিতে চান নিজের মতো করে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়। নিয়োগ বাণিজ্য করতে শূন্য পদের চাহিদাও দেওয়া হয় না। ’
একাধিক উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নেই। নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে আত্মীয়তা ও সম্পর্কই প্রাধান্য পায়। কিছু প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষক পরস্পর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এতে শিক্ষার্থীদের স্বার্থের পরিবর্তে পারিবারিক স্বার্থই মুখ্য হয়ে ওঠে। এগুলো বন্ধে সরকারকে এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
‘শিক্ষাকে পণ্য বানানো একটা বিপজ্জনক প্রবণতা। সমাজসেবার মুখোশে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন, তারা আসলে নিয়োগ, ভর্তি ও ফি-নির্ধারণে ব্যবসায়িক মানসিকতা দেখাচ্ছেন। এতে শিক্ষার গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশন ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস (ব্যানবেইস)–এর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের মোট প্রতিষ্ঠান ২১ হাজার ৮৬টি, এর মধ্যে ১৯ হাজার ৭৫৭টি বেসরকারি—অর্থাৎ প্রায় ৯৪ শতাংশই ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা। প্রাথমিক স্তরেও প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে। এ ছাড়া দেশে কারিগরি পর্যায়ে ৭ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার অনেকগুলোতেও অনিয়ম, অনুমোদন জটিলতা ও প্রভাবশালী পরিবারের নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ আছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষার প্রসার সবচেয়ে দ্রুত। তবে একই সঙ্গে বেড়েছে গুণগত বৈষম্য ও জবাবদিহির সংকট। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীভর্তি বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মাননিয়ন্ত্রণ কাঠামো তেমন শক্তিশালী হয়নি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এ খাতে তদারকি ও নীতিনির্ধারণে ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষা নীতিমালা অনুযায়ী ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকলেও বাস্তবে তা মানা হয় না। অনেক সময় স্থানীয় রাজনীতি, সামাজিক প্রভাব ও আর্থিক দাপটে এ নিয়ম উপেক্ষিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষাকে পণ্য বানানো একটা বিপজ্জনক প্রবণতা। সমাজসেবার মুখোশে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন, তারা আসলে নিয়োগ, ভর্তি ও ফি-নির্ধারণে ব্যবসায়িক মানসিকতা দেখাচ্ছেন। এতে শিক্ষার গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং অনুমোদনের নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার জানিয়ে এ অধ্যাপক আরও বলেন, আবেদনের পর এমপি-মন্ত্রীর সুপারিশে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়ার প্রথা বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু জমি দান করলেই সভাপতি হবেন, এমন নিয়ম থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। ম্যানেজিং কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যিনি যোগ্য তাকেই সুযোগ দিতে হবে। তবেই শিক্ষার উন্নয়ন হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার। তাদের মতে, শিক্ষক নিয়োগ, ম্যানেজিং কমিটি গঠন ও আর্থিক লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারি না আনলে শিক্ষাক্ষেত্রে এই নৈরাজ্য আরও বাড়বে।
বাংলাদেশে আজ যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে, তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এসব প্রতিষ্ঠানের সুশাসনের ওপর। কিন্তু সমাজসেবার নামে গড়ে ওঠা অনেক প্রতিষ্ঠান যখন পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে যায়, তখন শিক্ষা হারায় তার নৈতিক ভিত্তি—আর সমাজ হারায় প্রকৃত জ্ঞানবিস্তারীর লক্ষ্য।