টেলিযোগাযোগ আইনের নতুন খসড়া তৈরি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, যেখানে স্থায়ীভাবে ইন্টারনেট বন্ধের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং বিতর্কিত ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি দেশের ডিজিটাল শাসন কাঠামোয় একটি বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) তাদের ওয়েবসাইটে “বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ-২০২৫” এর খসড়া প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, “টেলিযোগাযোগ সংযোগ, সংশ্লিষ্ট সেবা বা ইন্টারনেট অ্যাক্সেস কোনও অবস্থাতেই বন্ধ, বিঘ্নিত বা সীমিত করা যাবে না।”
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেট বন্ধের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা বিলোপ করা এবং দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত নজরদারি ব্যবস্থার সংস্কার।
অবৈধ নজরদারি ও গুমের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বারবার সমালোচিত এনটিএমসি’কে বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
আইন প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “নতুন অধ্যাদেশে নজরদারির পুরো ধারণাটিই তুলে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “পূর্ববর্তী আইনের ৯৭ ধারাকে ব্যবহার করে বেসামরিক যোগাযোগের ব্যাপক নজরদারি চালানো হতো। নতুন আইনে সেই ব্যবস্থা শেষ করা হয়েছে। কোনও সামরিক বা নিরাপত্তা সংস্থা আদালতের অনুমতি ছাড়া কারও যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অননুমোদিতভাবে তা করলে কঠোর শাস্তির বিধান থাকবে।”
তিনি জানান, এখন থেকে নির্বিচার নজরদারির বদলে ‘বৈধ অনুপ্রবেশ’র ধারণা চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটি কেবল নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে এবং সীমিত সময়ের জন্য আদালত বা বিচারিক কাউন্সিলের পূর্বানুমোদনক্রমে করা যাবে; প্রয়োজনীয়তা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নীতির ভিত্তিতে।
তার ভাষ্য, কল, বার্তা বা ইন্টারনেট ট্রাফিকের তথ্য কেবল অপরাধ তদন্ত, জীবন রক্ষা বা জাতীয় নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে। কোনোভাবেই রাজনৈতিক বা আদর্শগত কারণে ব্যবহার করা যাবে না।
খসড়ায় বলা হয়েছে, বিচারিক অনুমোদনসাপেক্ষে সংগৃহীত তথ্য আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে, তবে অনুমতি ছাড়া সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্য আদালতে প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে না।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও ভয়েস ফর রিফর্ম সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর খসড়া আইনে ইন্টারনেট বন্ধের ওপর সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “এটি ডিজিটাল অধিকারের দিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে ‘বৈধ অনুপ্রবেশ’-এর সংজ্ঞা আরও স্পষ্ট করা দরকার। যেন কোনও অপব্যবহার না ঘটে, সেজন্য প্রতিটি অনুপ্রবেশের জন্য আদালতের অনুমতি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।”
১০২ ধারাবিশিষ্ট এই খসড়া অধ্যাদেশটি ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত জনমতের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। নাগরিকেরা ডাক বা ইমেইলের মাধ্যমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে মতামত পাঠাতে পারবেন।
পরামর্শ গ্রহণের পর খসড়াটি বহু-পক্ষীয় বৈঠকে আলোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও সংসদ বিভাগে পাঠানো হবে ভেটিংয়ের জন্য, এরপর তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই আইনের লক্ষ্য “নাগরিকদের অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগের অধিকার নিশ্চিত করা” এবং পূর্ববর্তী সেই কাঠামোটি প্রতিস্থাপন করা, যা স্বেচ্ছাচারী ইন্টারনেট বন্ধ ও গণ নজরদারির সুযোগ করে দিয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, “এটি জবাবদিহিতা ও সংস্কারের বিষয়। যে রাষ্ট্র একসময় নাগরিকদের নজরদারি করত, এখন সেই রাষ্ট্র তাদের যোগাযোগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়।”