মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির সঙ্গে জড়িত ১০৩ জন সিন্ডিকেট সদস্যের বিরুদ্ধে করা মানবপাচার, চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও মানিলন্ডারিং মামলায় সিআইডির দেওয়া ফাইনাল রিপোর্ট বাতিল করেছেন আদালত। গত রোববার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির পুনঃতদন্তের জন্য ডিটেকটিভ ব্র্যাঞ্চকে (ডিবি) নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত সূত্রে জানা যায়, পল্টন থানায় আফিয়া ওভারসিজের মালিক আলতাফ খান বাদী হয়ে ২০২৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মামলাটি (নম্বর-৬/৯/২০২৪) করেন। মামলায় অভিযোগ আনা হয়, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণের নামে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট মানবপাচার, চাঁদাবাজি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। গত ৩০ অক্টোবর এবং ২ নভেম্বর ঢাকার দায়রা জজ আদালত ও মানবপাচার প্রতিরোধ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মামলাটির ওপর শুনানি শেষে এই আদেশ দেন।
মামলার বাদী আলতাফ খান বলেন, আসামিদের প্রভাবে সিআইডি মনগড়া ও পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। আদালত সেই রিপোর্ট বাতিল করে সুবিচারের পথ খুলে দিয়েছেন। এদিকে মানবপাচারবিরোধী সংগঠনগুলো আদালতের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলছে, তদন্ত সঠিকভাবে হলে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে দীর্ঘদিন ধরে চলা দালাল ও সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। পল্টন থানায় হওয়া মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। সম্প্রতি সেই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি।
একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, সরকারপ্রধানের একজন বিশেষ সহকারীর তদবিরে সিআইডি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ওই বিশেষ সহকারী সিআইডি প্রধানকে ডেকে তিন দিনের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। আসামিরা হলেনÑ সাবেক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের প্রোপ্রাইটার রুহুল আমীন (স্বপন), আহমেদ ইন্টারন্যাশনালের প্রোপ্রাইটার বেনজীর আহমেদ প্রমুখ।
এদিকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে পরিচিত দুজন ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম ও রুহুল আমিন স্বপনকে আটক করে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ২৪ অক্টোবর ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা থেকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, আমিনুল ও রুহুল ভুক্তভোগী কর্মীদের কাছ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন এবং তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। ২০২২ সালের আগস্টে প্রায় ছয় বছর পর মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো পুনরায় শুরু হয়; তবে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার কর্মী যাওয়ার পর নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে প্রায় ১৭ হাজার অনুমতিপ্রাপ্ত কর্মী আর যেতে পারেননি। মালয়েশিয়া সরকার ২৫টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয়, যেগুলো ‘সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিতি পায় এবং এর পেছনে চারজন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা ছিল। সিন্ডিকেটের মালয়েশিয়া অংশের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয় নাগরিক আমিনুল ইসলাম আবদুন নুর, আর বাংলাদেশ অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপন। সরকার প্রতিটি কর্মীর অভিবাসন ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করলেও বাস্তবে প্রতিজনের কাছ থেকে গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশি অংশের নিয়ন্ত্রকেরা প্রতিজনের কাছ থেকে প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা এবং মালয়েশিয়ার নিয়ন্ত্রকেরা ভিসাপ্রতি প্রায় দেড় লাখ টাকা আদায় করেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রুহুল আমিন স্বপন দেশত্যাগ করেন বলে জানা গেছে।