Image description
অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ সময়েও সুবিধাভোগীদের প্রাধান্য, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ক্ষোভ সৃষ্টি

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে ইতোমধ্যে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ সময়েও প্রশাসনে সচিব পদোন্নতিতে আবারো ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

গত ১৬ বছর প্রশাসনে যেসব কর্মকর্তা আওয়ামীপন্থি হিসেবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারে আমলে অনুগত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দায়িত্ব পালন করে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেনÑ এসব কর্মকর্তা বর্তমান সরকারে সময়ে ভোল পাল্টে আগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করতে পারে এমন একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তারা সবাই হাসিনার সুবিধাভোগী আমলা। প্রশাসনের বঞ্চিতরা মনে করেছিলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব যোগদানের পরে আর হয়তো ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলারা পদোন্নতি পাবেন না। বাস্তবে ভিন্নতা লক্ষ্য করছেন তারা। গত রোববার রাতে প্রশাসনে তিনজন অতিরিক্ত সচিবকে পদোন্নতি দিয়েছে। তাদের পদোন্নতির পর তাদেরকে তিন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পদায়ন করেছে সরকার। অপরদিকে, একজন সচিবকে নতুন করে পদায়ন বাইরে দেয়া হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত এক বছর ১৫ মাসে প্রশাসনজুড়ে ফ্যাসিবাদী আমলাদের জয়জয়কার। আবার বিগত ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা বঞ্চিত ছিলেন আবারো এসব কর্মকর্তা বঞ্চিত থাকছেন। গত রোববার রাতে প্রশাসনে তিনজন অতিরিক্ত সচিবকে পদোন্নতি দিয়েছে, তারা সবাই হাসিনার সুবিধাভোগী আমলা। তাদের পদোন্নতির পর তাদেরকে তিন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পদায়ন করা হয়েছে। আর একজন সচিবকে নতুন করে পদায়ন করা হয়েছে।

প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কতিপয় উপদেষ্টা ও কর্মকর্তা অসৎ উদ্দেশে ‘রুলস অব বিজনেস’-এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ওই কমিটি গঠন করে প্রশাসনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। কমিটি বাতিল নয়; বরং জনপ্রশাসনকে অকার্যকর ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বিগত এক বছর চার মাসে যেসব উপদেষ্টা ও কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিষয়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্তপূর্বক দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে বলে দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। তারা বলেছেন, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুসারী কর্মকর্তাদের সচিবসহ বিভিন্ন উচ্চতরে পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশে জনপ্রশাসনে আওয়ামী দোসর কর্মকর্তাদের সুরক্ষা প্রদান, জেলা প্রশাসকসহ উচ্চতর পদে পদোন্নতি ও পদায়ন করে জনমনে গোটা প্রশাসন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ সময়েও প্রশাসনে সচিব পদোন্নতিতেও বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। গত এক বছর ধরে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব পদোন্নতিতে বিগত সরকারের সুবিধাভোগীদের প্রাধান্য দেয়া প্রশাসনে সমালোচনার অন্ত ছিল না। একইভাবে সুবিধাভোগীদের জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়েও প্রশাসনে নানা বিতর্ক রয়েছে। এতে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। সাবেক জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমানের পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত তাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয় সরকার। সমালোচনা মুক্ত হতে জনপ্রশাসন-বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিও বাতিল করে সরকার। প্রশাসনের অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন, পদোন্নতি ও পদায়নে বিগত সরকারের আমলে বঞ্চিত এবং যোগ্য কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া হবে। এরপরও সরকার সমালোচনা থেকে বের হতে পারেনি। প্রশাসনের বঞ্চিতদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও স্বৈারাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়মিত পদোন্নতি পাওয়া এবং ওই সরকারের ঘনিষ্ঠরাই সর্বশেষ সচিব পদোন্নতি পেয়েছেন। গত রোববার রাতে এ সংক্রান্ত পৃথক পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিসিএস প্রশাসন ১৭ ব্যাচ থেকে সচিব পদোন্নতি দেয়া হয়। এর মধ্যে বিসিএস ১৫ ব্যাচের এক কর্মকর্তাকে সচিব পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তবে বিসিএস ১৭ ব্যাচের মেধাক্রমের প্রথম কর্মকর্তা আবার সুবিধাভোগী হলেও তাকে সচিব পদোন্নতি দিলেও সিনিয়রিটি লঙ্ঘন করে মেধাক্রমের নিচে থাকা অন্য কর্মকর্তাকে সচিব পদোন্নতি দেয়ায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তবে দুজনই নারী কর্মকর্তা। তার বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের সামনের সারির কর্তা ছিলেন। ওই সংগঠনের শীর্ষদের ইশারায় বিগত সরকারের আমলে নারী কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক, পদোন্নতি ও পদায়ন হয়েছে বলে টক অব দ্য প্রশাসন ছিল। সেই সংগঠনের সম্মুখসারীর নারী কর্মকর্তাদের অতীতের মতো শুধু ব্যক্তি সখ্যকে প্রাধান্য দিয়ে সচিব করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সিনিয়রিটি লঙ্ঘন করে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আবার বিসিএস ১৫ ব্যাচের যোগ্য দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে একজনকে সচিব করা হয়েছে। এখানেও যোগ্যতা নয়, আঞ্চলিকতা ও ব্যক্তি সখ্যকেও প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কোন অদৃশ্য শক্তির বলে আবারো ফ্যাসিস্ট আমলের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারাই বারবার পদোন্নতি পেয়ে আসছেন। এর রাশ টানবে কে? তারা ভোটের মাঠে নতুন ষড়যন্ত্র করবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুস সবুর ইনকিলাবকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে পদোন্নতির মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের অবস্থান শক্ত করা হচ্ছে। এতে করে যোগ্য কর্মকর্তারা পিছিয়ে পড়ছেন। মেধার অগ্রভাবে থাকা সত্ত্বেও নাম বাদ পড়াটা প্রশাসনে বার্তা দিচ্ছে যে, সম্পর্কই এখন দক্ষতার চেয়ে বড়। যোগ্যতা-ভিত্তিক প্রশাসন গড়তে হলে এমন পদক্ষেপ উল্টো ফল দেবে। অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ সময়ে প্রশাসনে এই পদোন্নতি নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক আবারো প্রমাণ করেছে।

জানা গেছে, আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ডিসেম্বর প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হতে পারে। আর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হলে জনপ্রশাসনসহ অন্যান্য সংস্থায়ও সব ধরনের পদোন্নতি ও পদায়ন বন্ধ থাকবে। সাম্প্রতিক প্রশাসনে সর্বোচ্চ সচিব পদোন্নতি অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের ‘শেষ পদোন্নতি’ ধরে নিয়েছেন। এ নিয়ে প্রশাসনে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে বিসিএস ১৭ ব্যাচের সুবিধাভোগী দুই নারী কর্মকর্তার পদোন্নতিতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। এ ঘটনায় তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনে পদোন্নতিতে যোগ্যতা নয়, সুবিধাভোগী ও বিশেষ বিবেচনা প্রাপ্ত কর্মকর্তারাই অগ্রাধিকার পেয়েছেন।

১৭ ব্যাচের কর্মকর্তারাই বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন। সিনিয়রটি অগ্রভাবে আবার যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে বারবার পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছিল। শিক্ষা জীবনে সব বিভাগে প্রথম স্থান অর্জনকারী কর্মকর্তারাও বঞ্চিত হয়ে অধিকতর জুনিয়রদের অধীনে চাকরি করতে হয়েছে। সামাজিক মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেও সিনিয়র সহকারী সচিব বা উপসচিব হয়ে বছরের পর বছর গুরুত্বহীন দফতরে থাকতে হয়েছে। এসব কর্মকর্তা ৫ আগস্টে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষতাচ্যুতের পর অনেকেই ভূতাপেক্ষ সিনিয়রটিসহ পদোন্নতি পেয়েছেন। এরপরও রহস্যজনকভাবে তারা গত এক বছরে পদে পদে উপেক্ষিত হয়েছেন। গত রোববার রাতে তিনটি পৃথক পৃথক প্রজ্ঞাপনে তিনজন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতির পর পদায়ন করা হয়।

অর্থ বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব বিলকিস জাহান রিমিকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নরুন্নাহার নাহার চৌধুরীকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সচিব মো. শওকত রশীদ চৌধুরী পদোন্নতি পেয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে বিভাগের সচিব করা হয়েছে। অন্যদিকে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত সচিব এস এম শাকিল আখতারকে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব পদে পদায়ন করা হয়েছে। দুই নারী কর্মকর্তা বিসিএস ১৭ ব্যাচের। সিনিয়র কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও তার নাম বিবেচনায় আনা হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান সরকারের আমলেও পদোন্নতির এ ধরনের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কের বিষয়টি স্পষ্ট। প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, যাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে সবাই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে ছিলেন। তবে যাদের বাদ দেয়া হয়েছে তারা মাঠ প্রশাসনে দক্ষতার জন্য পরিচিত ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিএস ১৭ ব্যাচের এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা ছিল বেশি। কিন্তু বঞ্চিতদের অগ্রাধিকার না দিয়ে সুবিধাভোগীদের বারবার সুবিধা দেয়া হয়েছে। হাসিনার আমলে যারা নিয়মিত পদোন্নতি ও পদায়ন পেয়েছেন তাদেরই সচিব করা হয়েছে। যে দুই নারী কর্মকর্তাকে সচিব করা হয়েছে তারা বিগত সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন। এটি প্রশাসনিক ন্যায্যতার পরিপন্থি। আর যারা এক যুগেরও বেশি সময় বঞ্চিত ছিলেন, তাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে।