Image description

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঢাকার সড়ক পরিবহন, বিশেষ করে বাস খাতে প্রকাশ্যে নেতাদের পরিবর্তন হয়েছে। তবে কৌশলে বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আত্মীয়-স্বজনসহ অন্য ঘনিষ্ঠরা। আর পলাতক এনায়েত চক্রের হাতে রয়েছে অর্ধশতাধিক বাস কম্পানির নিয়ন্ত্রণ। পরিবহন খাতের বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে এ পরিস্থিতির কথা জানা গেছে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বসুমতি ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান পদে এখনো বহাল আছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তাঁর ৪০টি ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাঁর নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে ২৩৫টি বাসের দালিলিক প্রমাণ মিলেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, এগুলো গোপনে বিক্রির চেষ্টা করছেন এনায়েত উল্লাহ।

সড়ক পরিবহন খাতে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি পালিয়ে দুবাইয়ে অবস্থান করলেও তাঁর চক্রের সদস্যরা কৌশলে বাস খাতের বড় বড় রুটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।

পুরনো চক্রের ছায়া : জানা গেছে, রাজধানীতে চলাচলকারী ‘প্রজাপতি পরিবহন’ কম্পানির নিয়ন্ত্রণ ছিল পঙ্কজ দেবনাথের হাতে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর পঙ্কজ দেবনাথ দৃশ্যপট থেকে দূরে চলে যান।

পরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে কম্পানির হাল ধরেন পঙ্কজের ডান হাত বলে পরিচিত কে এম রফিকুল ইসলাম। ২০১৪ সালে তিনি বিহঙ্গ পরিবহন কম্পানির পরিচালক ছিলেন। ওই সময় পরিবহনের চেয়ারম্যান ছিলেন পঙ্কজ দেবনাথ। কে এম রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, “পঙ্কজ দেবনাথের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল।
 
ব্যবসার সুবাদে আমিও রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম। তবে আমি কারো ‘ডান হাত’ নই।” এই কম্পানির পরিচালক পদে আছেন রফিকুলের শ্যালক রেদওয়ানসহ পরিবারের একাধিক সদস্য। এভাবে শুধু প্রজাপতি পরিবহন নয়, রাজধানীর উল্লেখযোগ্য পরিবহন কম্পানির নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ চক্রের হাতেই রয়েছে। যদিও বিভিন্ন কমিটি থেকে আওয়ামী লীগপন্থীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা পরিস্থিতির কারণে তাঁরা আর আগের পদে নেই। কেউ আছেন জেলে, কেউ আবার প্রাণ রক্ষায় পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন।  পতিত আওয়ামী লীগ আমলে পরিবহন খাতে বড় চক্র গড়েছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন

মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। সড়ক পরিবহন মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন, শাখা সংগঠন ও পরিবহন কম্পানিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো ছিল তাঁর চক্রের সদস্যদের দখলে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, শাখা কমিটি গঠন করতে না পারায় আগের চক্রের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি। পরিবহন কম্পানির রাস্তায় চলাচলের জন্য সব প্রক্রিয়ার সঙ্গেও পুরনো চক্রের সদস্যরা যুক্ত হয়ে আছেন।

পাওয়া তথ্য মতে, আগে গড়ে ওঠা চক্রে সক্রিয় ছিলেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের এমপি, থানা আওয়ামী লীগ নেতা, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সাবেক নেতাকর্মী, পুলিশের সাবেক কমিশনার ও ট্রাফিক বিভাগের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাঁরাই পরিবহনে চাঁদাবাজির সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত থেকে ফায়দা নিয়েছেন। জানা গেছে, রাজধানীতে অর্ধশতাধিক বাস কম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য পরিচালক পদগুলোয় সাবেক পরিবহন নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহর চক্রের সদস্যরা বহাল তবিয়তে আছেন। আগের চক্রের সদস্যরা রয়েছেন মিরপুর-১ ও মিরপুর-১২-এর বিভিন্ন স্ট্যান্ড, গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল থেকে চলাচলকারী বিভিন্ন রুটের বাস কম্পানিতে। এসব কম্পানির মধ্যে প্রজাপতি ছাড়াও রয়েছে পরিস্থান, এনা, রবরব, বসুমতি ট্রান্সপোর্ট, মিরপুর সুপার লিংক, শিকড়, বিকল্প অটো সার্ভিস, বিহঙ্গ, রাজধানী, স্বাধীন, অছিম, ইতিহাস, ঠিকানা, রইছ, প্রত্যয় ও ওয়েলকাম। এ ছাড়া আছে মৌমিতা, বৈশাখী, আলিফ, মধুমতি, ইতিহাস, ঠিকানা, ভিআইপি, লাব্বাইক, রাইদা, আয়াত, হিমাচল, ঢাকার চাকা, রজনীগন্ধা ও রমজান পরিবহনসহ বিভিন্ন কম্পানি। 

তবু এমডি এনায়েত উল্লাহ : আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বসুমতি ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান পদে এখনো বহাল আছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তাঁর অনুসারী ছিলেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তৎকালীন ক্যাশিয়ার আবুল মুনসুর বুলবুল। এনা পরিবহন দেখভালের পাশাপাশি বুলবুল বসুমতির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছেন। বুলবুলের হয়ে মাঠে সক্রিয় আছেন সৈয়দ কামরুল হক (দুলাল), আল আমীন, নুরুন নবী (সবুজ), জসিম, আয়নালসহ বেশ কয়েকজন সদস্য। তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আগে থেকেই জড়িত। আবুল মুনসুর বুলবুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ৫ আগস্টের পর এনায়েত উল্লাহ চলে যাওয়ায় শূন্যপদ পূরণ করেছি মাত্র। একসময় তিনি ছিলেন আমাদের নেতা। এখন তাঁর সঙ্গে  আমার সম্পর্ক নেই। জানা গেছে, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির উত্তর অংশের আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে এনায়েত উল্লাহর হয়ে কাজ করছেন তাঁর বন্ধু খোকন আহমেদ। তিনি ধানমণ্ডি থানা আওয়ামী লীগ নেতা ও এই সমিতির কার্যকরী সভাপতি ছিলেন। এনায়েত চক্রের আরেকটি অংশের সক্রিয় সদস্য হুমায়ুন কবির তপন। তিনি পল্লবী থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির ক্যাশিয়ার ছিলেন। মিরপুরের বিভিন্ন বাস কম্পানি থেকে চাঁদাবাজি করছেন তপন। রাজধানী পরিবহনের চেয়ারম্যান পদে আছেন এনায়েত উল্লাহর বড় ভাই খন্দকার মনির। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া বৃহত্তর মিরপুর অঞ্চলের শাখা কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। গাবতলী বাস টার্মিনালের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এখন দেলোয়ার হোসেনের হাতে। তিনি শ্রমিক লীগ নেতা কালু শেখের ঘনিষ্ঠজন। দেলোয়ার অছিম পরিবহন কম্পানির চেয়ারম্যান, ইতিহাস ও ঠিকানা পরিবহনের পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি, মৌমিতা ও ওয়েলকাম পরিবহনের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক, রইছ পরিবহনের চেয়ারম্যান ও প্রত্যয় পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। বসুমতি ও রাজধানী পরিবহনসহ গাবতলীতে অধিকাংশ বাস কম্পানি তাঁর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি ৫০টি বাস ও ২০টি ভেকুর (মাটি কাটার যন্ত্র) মালিক। এ বিষয়ে জানতে দেলোয়ারের মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। প্রথমে তিনি কল কেটে দেন, পরে তাঁর ফোনে আর সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি।

বিভিন্ন বাস কম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্রিয় রয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি শাহিদা তারেখ দীপ্তি। তিনি প্রজাপতি পরিবহনের চেয়ারম্যান। বিহঙ্গ পরিবহনের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি পঙ্কজ দেবনাথ। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তবে গত মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পরিবহন মালিকদের চাপে তিনি আগের অবস্থান থেকে সরে যান। 

পরিস্থান পরিবহনের চেয়ারম্যান ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য শেখ শিরিন শান্তি। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ইলিয়াস হোসেন মোল্লার ঘনিষ্ঠজন।  অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থান পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বিএনপিপন্থীদের সরিয়ে পারিবারিকভাবে আধিপত্য গড়ে তোলেন তিনি। এখন পরিস্থান পরিবহন কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শান্তির স্বামী ওয়াজ উদ্দীন ও পরিচালক ছেলে মো. সাগর। মিরপুর সুপার লিংক পরিবহন কম্পানির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ইলিয়াস হোসেন মোল্লার চাচাতো ভাই হোসেন মোল্লা। শিকড় পরিবহনের উপদেষ্টা আওয়ামী লীগের সাবেক ওয়ার্ড কামিশনার আব্দুর রউফ ওরফে নান্নু। বিকল্প অটো পরিচালনা করছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান। তিনি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। রবরব পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের দুই নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি সুমন আলী। কম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পল্লবী থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম হোসেন নোমান। ভিআইপি পরিবহনের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের লালবাগ থানার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রিপন দেওয়ান এখন বিএনপির সাইনবোর্ড ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া কম্পানির দেখভাল করছেন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান। লাব্বাইক পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ধামরাইয়ের মো. হাসান। তিনি মানিকগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। রাইদা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মকবুল হোসেন মঙ্গল, তৎকালীন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সদস্য ছিলেন। অছিম পরিবহানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আছেন তৎকালীন বৃহত্তর মিরপুর পরিবহন মালিক সমিতির ক্যাশিয়ার কাউসার হোসেন। এ ছাড়া মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার স্বাধীন পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।