পতিত আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাতে কিছুটা সফল হলেও বিপরীতমুখী অবস্থানে পুঁজিবাজার। নানামুখী সংস্কার ও পদক্ষেপের মাধ্যমেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বাজারটি। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও একদিকে সূচক বাড়ে অন্যদিকে লেনদেন কমে। তলানিতে ঠেকেছে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর আস্থা। যদিও বিএসইসি আশ্বাস দিয়ে বলেছে, কমিশন পুঁজিবাজারে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং আগামী দুই মাসের মধ্যেই সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হবে।
বিনিয়োগকারী কমছে: আস্থাহীনতায় ইতিমধ্যে বাজার ছেড়েছেন হাজারো বিনিয়োগকারী। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্যমতে, পাঁচ মাস আগে অর্থাৎ গত মে মাসে পুঁজিবাজারে মোট বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫১১টি, যা সর্বশেষ গত ২২শে অক্টোবর ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫টিতে নেমে আসে। অর্থাৎ গত পাঁচ মাসে পুঁজিবাজারে ৪৭ হাজার ৪৭৬টি হিসাব বন্ধ হয়েছে।
মূলধন হ্রাস: বাজার মূলধন প্রতিদিন কমছে। চলতি মাসের ১২ থেকে ১৬ই অক্টোবরেই বাজার মূলধন কমেছে ৩১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। গত এক বছরে বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত পুঁজি কমেছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি।
আইপিও খরা: বর্তমান কমিশনের সময়ে একটি নতুন আইপিও অনুমোদন পায়নি। যা নতুন মূলধন প্রবাহকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৬৪ হাজার বিনিয়োগকারী তাদের পোর্টফোলিও বিক্রি করে বাজার ছেড়েছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ডিএসইএক্স সূচক ২০২৪ সালের ১৮ই আগস্টে ছিল ৫ হাজার ৭৭৮.৬৪, যা ২০২৫ সালের ৩রা জুনে নেমে আসে ৪ হাজার ৬৬৪.৭৯-এ। অর্থাৎ এক হাজার ১১৩.৮৫ পয়েন্ট বা ১৯.২৮ শতাংশ কমেছে। যা বর্তমানে ৫ হাজারে ১২৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এদিকে পুঁজিবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে আইপিও নিয়ে মতামত চেয়েছে কমিশন।
টাস্কফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়ন নেই: শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করতে হাসিনার পতনের পর সরকার টাস্কফোর্স গঠন করে। শেয়ারবাজারে আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে ১৭টি বিষয়ে সংস্কার সুপারিশ করা হয়। অথচ টাস্কফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়নের নাম নেই। এ ছাড়া চলতি বছরের মে মাসে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি কয়েকটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে (এমএনসি) থাকা সরকারি শেয়ার অফলোড ও দেশীয় বড় বড় কোম্পানিকে তালিকাভুক্তি করা এবং বড় বড় কোম্পানি যাতে ব্যাংকঋণ নেয়ার বদলে পুঁজিবাজারে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী হয়, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। এই নির্দেশনার পর ইতিমধ্যে ছয় মাস অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু কোনোকিছু বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। একইসঙ্গে ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে (এসওই) বাজারে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টাও স্থবির হয়ে পড়েছে। আর তাই বাজারে উল্টো চিত্র বিরাজমান। প্রতিদিন পুঁজি হারিয়ে হতাশ বিনিয়োগকারীরা।
বিনিয়োগকারীদের বক্তব্য: তারা বলেছেন, কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী ফোর্সড সেলের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এতে তাদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে হতাশা। বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের অপসারণের দাবি করেছেন বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি এ নিয়ে বিক্ষোভ করেন বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর এসোসিয়েশনের সভাপতি ইকবাল হোসেন বলেন, পুঁজিবাজার বন্দি হয়েছে এক নব্য স্বৈরাচারের আয়নাঘরে। বাজার ফেরাতে রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।
ডিএসই’র চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, সরকারি কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে চেষ্টা চলছে। তিনি জানান, পাবলিক ইস্যু রুলসে যে সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সংশোধন আনার প্রক্রিয়া চলছে। ভালো কোম্পানিকে দ্রুত ও স্বল্পসময়ে তালিকাভুক্ত করতে গ্রিন চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সূত্র মতে, গত বছরের ১৮ই আগস্ট দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নানাভাবে বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বর্তমান রাশেদ মাকসুদ কমিশন। অথচ সবাই মনে করেছিল- নতুন, সংস্কারমুখী নেতৃত্ব বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করবে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় আধুনিকায়ন আনবে এবং ডুবন্ত পুঁজিবাজারকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ায়নি বাজার।
বিএসইসি’র চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, কমিশন পুঁজিবাজারে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং আগামী দুই মাসের মধ্যেই সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, কমিশন বর্তমানে পুঁজিবাজার সংস্কারে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তিনি সংস্কারের মূল ক্ষেত্র হিসেবে মার্জিন রুলস, মিউচুয়াল ফান্ড প্রবিধান, আইপিও প্রবিধান এবং করপোরেট গভর্ন্যান্স নীতিমালা আধুনিকায়নের কথা উল্লেখ করেন। বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অতীতের অনিয়মের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন কাজ করছে বলেও তিনি জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই সার্বিক উদ্যোগের সুফল খুব শিগগিরই পাওয়া যাবে।
বাজার বিশ্লেষণ: সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার ডিএসই’র অধিকাংশ শেয়ার ও ইউনিটের দর বেড়েছে। তবে সার্বিক লেনদেনে ভাটা পড়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিএসইতে মোট ৩৯৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ২৪১টির। বিপরীতে কমেছে ৮১টির। আর ৭২টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৩০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১২২ পয়েন্টে। আগের দিন এ সূচক ছিল ৫ হাজার ৯২ পয়েন্টে। ডিএসইতে আগের তুলনায় লেনদেন কমেছে ২৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকার। এদিন মোট ৪৭৬ কোটি ১০ লাখ টাকার সিকিউরিটিজ লেনদেন হয়েছে। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৫০৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) মূল্যসূচকের মিশ্র প্রবণতায় লেনদেন শেষ হয়েছে।