Image description
জুলাই সনদ নিয়ে সুপারিশ

রীতিমতো কেরামতি দেখালো জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে সুপারিশ দিয়েছে তাতে তাদের এই কেরামতি ধরা পড়েছে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে ৩০টি দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল কমিশন তার সুপারিশে এই ঐক্য ভেঙে দেয়ারই যেন চেষ্টা চালিয়েছে। কমিশনের জমা দেয়া সুপারিশে ক্ষুব্ধ বিএনপিসহ অনেক দল। তারা বলছে, আলোচনায় ঐকমত্য হওয়া বিষয়ে কমিশন নিজের মতো সুপারিশ দিয়েছে। এতে সরকার এবং কমিশনের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং দু’টি রাজনৈতিক দল একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে- এমন অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলগুলোর দেয়া নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়ে সুপারিশ দেয়া, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি তা টেনে সুপারিশে নিয়ে এসে কমিশন রীতিমতো জাতির সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে দলগুলোর নেতারা মনে করছেন। কমিশনের দেয়া সুপারিশ সংশোধন না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন তারা। 

গত ১৭ই অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে সই করে ২৪টি রাজনৈতিক দল।  পরে গণফোরাম সনদে সই করে। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেয়া ৩০ দলের মধ্যে এনসিপি এবং চারটি বাম দল এখনও সনদে সই করেনি। এনসিপি অবশ্য সনদ বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগ দেখে সইয়ের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে। সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান সংক্রান্ত ৪৮টি বিষয়ে গণভোট  দেয়ার সুপারিশ করেছে। এই বিষয়গুলোতে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিল। শেষ মুহূর্তের আলোচনায় কমিশন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই নোট অব ডিসেন্টসহ সনদ চূড়ান্ত হবে। কিন্তু সুপারিশে কমিশন এই নোট অব ডিসেন্ট এর বিষয় উল্লেখ করে। এতে নোট দেয়া দলগুলো চরম ক্ষুব্ধ। তারা বলছে, কমিশন তাদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। 

দলগুলো বলছে, কমিশন এমন অনেক বিষয়ে গণভোটের কথা বলেছে, যেগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। এ সব বিষয় যথাযথভাবে উল্লেখ না করেই সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হয়েছে সুপারিশে। যা কোনোভাবেই ‘ঐকমত্য’ হতে পারে না। জুলাই জাতীয় সনদে ৮৪টি সিদ্ধান্তের মধ্যে মৌলিক ১৪টি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এরমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি ও প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে না থাকাসহ এমন বেশকিছু ইস্যুতে আপত্তি রয়েছে বেশি।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তাদের সমমনা কয়েকটি দল- মোট ৯ টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি জানিয়েছে। বাম দলগুলোর ৪টি ও ইসলামী দলগুলোর ৩টি বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। কেউ কেউ পূর্ণাঙ্গ নোট দিয়েছে, কেউ দিয়েছে আংশিক। সূত্র বলছে, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার বাইরেও অনেকগুলো প্রস্তাব করেছে কমিশন। যেগুলো অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এই কমিশন সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়া ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উপেক্ষা করেছে, যা কোনোভাবেই ‘ঐকমত্য’ হতে পারে না।

ফখরুল প্রশ্ন তুলে বলেন, এটা তো ঐকমত্য হতে পারে না। তাহলে ঐকমত্য কমিশনটা করা হয়েছিল কেন? এই ঐকমত্য কমিশন আমি বলবো, এটা জনগণের সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলোর একটা প্রতারণা। এটা অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন। কমিশনের আলোচনায় অধিকাংশ দল নির্বাচনের দিন গণভোটের বিষয়ে মতামত দিয়েছে। সেটা বিবেচনা না করে কমিশন নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন গণভোট হতে পারে এমন সুপারিশ দিয়েছে। বাস্তবে কমিশনের অবস্থান ও দু-একটি দলের অবস্থান একই বোঝা যাচ্ছে। 

গতকাল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, আমাদের আপসহীন অবস্থানের কারণে ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে এ বিষয়ে সুপারিশ করেছে। আইনি ভিত্তিসম্পন্ন আদেশের খসড়া সরকার গ্রহণ করলে সনদ স্বাক্ষরের বিষয়ে অগ্রগতি তৈরি হবে।
এসব বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন,  সরকারের উচিত হবে যেসব বিষয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা রয়েছে। সেসব প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেয়ে, যেসব বিষয়ে দলগুলোর সাধারণ ঐকমত্য আছে এর ওপর দাঁড়িয়ে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া। সরকারের উচিত হবে ঐকমত্যের বিষয়গুলো নিয়ে পরবর্তী গণভোট ও পদক্ষেপগুলো নেয়া।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। এটাকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেয়া হচ্ছে। সংবিধানের ওপরে কোনোকিছুকে প্রাধান্য দেয়া হলো রাজনৈতিক, আইনগত এবং সবদিক থেকেই রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করার একটি অপপ্রয়াস। বর্তমান কমিশন যে বাস্তবায়ন সুপারিশ দিয়েছে তা বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এটাকে কেন্দ্র করে জুলাই সনদই একটি অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাচ্ছে। এটা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে যারা সক্রিয় তাদেরকে একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়া। যারা এই সনদে স্বাক্ষর করেছে তারা আগামী সংসদে এটা বাস্তবায়ন করতে দায়বদ্ধ থাকবে। কেউ না করলে রাজনৈতিকভাবে তার অপমৃত্যু হবে। জনগণের কাছে এর জবাবদিহিতা থাকবে। 

জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) মহাসচিব মোমিনুল আমিন মানবজমিনকে জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশ নজিরবিহীন ছলচাতুরির আশ্রয়। জাতির সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল এটি। কমিশন আমাদের নোট অব ডিসেন্টগুলো আমলে নেয়নি। কমিশন নিজেদের মত করে বাস্তবায়ন সুপারিশ তৈরি করেছে। এখানে রাজনৈতিক দল ও জনগণ উভয়কেই উপেক্ষা করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার পরিষদের যে বিষয়টি বলা হয়েছে তারা করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হবে। কমিশনের ইচ্ছাকেই চাপিয়ে দেয়া হলো।