ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রায় দেড় বছর ধরে চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন অন্য বিভাগের শিক্ষকরা। যার চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল, তাকে অব্যাহতি দেওয়ায় এবং অন্যান্য শিক্ষকের অনাগ্রহ ও সমন্বয়হীনতার কারণে পদাধিকার বলে দায়িত্ব পালন করছেন বিভাগের বাইরের শিক্ষক। এ কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় নানা কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রিতা ও ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
জানা গেছে, বিভাগে চেয়ারম্যান কার পরে কে হবেন তার ক্রম সাধারণত জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ঠিক হয়ে থাকে। গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহাম্মদের দায়িত্ব পালন শেষ হয়েছে গত বছরের জুন মাসে। নিয়মানুযায়ী এরপরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের কথা ছিল অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের। কিন্তু তার আগেই শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্তের জন্য তাকে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
“অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ শেষ না হওয়ায় এবং তার করা রিটের কারণে আইনি জটিলতার আশঙ্কায় সিরিয়ালে থাকা শিক্ষকগণ আগ্রহ না দেখানোয় বিভাগ থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টি থমকে আছে” - শিক্ষক, গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাবি।
তদন্ত শেষ না হওয়ায় এবং অভিযোগটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় তিনি এখনো বিভাগে ফিরতে পারেননি। তাছাড়া, চেয়ারম্যান পদের জন্য তার আইনি অবস্থানের কারণে জটিলতা তৈরি হওয়ায় অন্য শিক্ষকদের কেউ এ দায়িত্বও নেননি৷ যার কারণে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পদাধিকার বিবেচনায় অনুষদের ডিনকে দায়িত্বভার দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের কথা হয়। তারা জানান, অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহাম্মদের চেয়ারম্যানশিপ শেষ হওয়ার পর ২০২৪ সালের জুন মাসে অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেসময় এর আগে তোলা তার বিরুদ্ধে নিজ বিভাগের নারী শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের সত্যতা পায় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি এবং বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে পাঠানো হয়। পাশাপাশি তাকে তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
“শিক্ষার্থীরা একটা পেপারে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য গেলেও কোনো কোনো সময় ঝামেলা পোহাতে হয়। আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে আমাদের বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়হীনতা রয়েছে” - শিক্ষার্থী, গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাবি।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, অধ্যাপক নাদিরকে যেহেতু অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং তাকে দায়িত্ব দেওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু পদাধিকারবলে ডিনকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তখন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদা ইরশাদ নাছির এ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত ডিন হিসেবে নিয়োগ পান উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমান। এরপর থেকে তিনিই বিভাগটির চেয়ারম্যানশিপের দায়িত্ব পালন করছেন।
বিভাগ থেকে কোনো শিক্ষককে চেয়ারম্যান করতে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের অব্যাহতির পর হাইকোর্ট থেকে তার দায়িত্ব (চেয়ারম্যানশিপ) গ্রহণের ব্যাপারে একটি রিট করেছিলেন। যেখানে তিনি দাবি করেন, তার পরিবর্তে অন্য কাউকে দায়িত্ব দিলে সিনিয়রিটি বা জ্যেষ্ঠতা ক্ষুণ্ন হবে এবং নিয়ম ভঙ্গ হবে।
এ প্রেক্ষিতে ডিনের পরিবর্তে বিভাগের কোনো শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়ার বৈধতা আছে কিনা, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বিভাগটির শিক্ষকদের নিয়ে মতবিনিময় করেন। এ প্রেক্ষিতে ক্রমানুযায়ী অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস এবং অধ্যাপক ড. এস এম শামীম রেজাকে দায়িত্ব নিতে বলা হলেও তারা অস্বীকৃতি জানান বলে জানা গেছে। যার কারণে, উপাচার্য ডিনকেই এ দায়িত্বে থাকার কথা জানান।
“উনাকে ঘিরে বিভাগটিতে এ সংকটের সূচনা। আপাতত বিভাগে স্ট্যাবিলিটি (স্থিতিশীলতা) ঠিক রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনুষদ ডিনকে ওখানে রেয়েছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। উপাচার্য মহোদয় বিদেশে আছেন, তিনি দেশে আসলে তার সঙ্গেও বসব” - অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমান, ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাবি।
এ ব্যাপারে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগটির এক শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ শেষ না হওয়ায় এবং তার করা রিটের কারণে আইনি জটিলতার আশঙ্কায় সিরিয়ালে থাকা শিক্ষকগণ আগ্রহ না দেখানোয় বিভাগ থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টি থমকে আছে।
তিনি বলেন, তারা হয়তো মনে করছেন, দায়িত্বভার গ্রহণ করে আইনি জটিলতার কারণে আবার তা ছেড়ে দিতে হলে বিষয়টি অসম্মানজনক হতে পারে। এ জটিলতায় সৃষ্ট সমস্যার কারণে বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী উভয়েই ভুক্তভোগী হচ্ছেন এবং বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, রেগুলার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অন্য কেউ প্রোপারলি পালন করতে পারবে না। আর একজন ডিনের অনেক ব্যস্ততা থাকাটা স্বাভাবিক।
বিভাগের আরেক শিক্ষক বলেন, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে রিপোর্টের প্রেক্ষিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বিভাগের সমস্যাটি সমাধান হতে পারে।
অন্যদিকে, তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি প্রতিরোধে পুনর্গঠিত যৌন নিপীড়নবিরোধী কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. ডালিয়া পারভীন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, তদন্তের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় আমাদের জানানোর এখতেয়ার নেই। যখন জানানো প্রয়োজন হবে, তখনই আমরা জানাবো। তবে দ্রুততা ও শুদ্ধতার সাথে নিয়ম মেনে বিরোধ নিষ্পত্তি করাই আমাদের কাজ। সেটাই আমরা করছি।
সৃষ্ট সংকটের বিষয়ে নিজের মতামত জানিয়ে বিভাগটির এক শিক্ষার্থী পরিচয় না প্রকাশের শর্তে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিভাগের শিক্ষকদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান থাকার সুবিধা হলো বিভাগের অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন, কারিকুলাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে তার জানা-শোনার পরিধি বেশি থাকে৷ ফলে বিভাগের সামগ্রিক বিষয়ের প্রতি তিনি পর্যাপ্ত সময় এবং শ্রম দিতে পারেন৷ কিন্তু ডিন এ বিষয়গুলো চাইলেও পারেন না। কারণ, তার অনেক দায়িত্ব থাকায় ব্যস্ততাও অনেক বেশি থাকে। ফলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা একটা পেপারে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য গেলেও কোনো কোনো সময় ঝামেলা পোহাতে হয়। আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে আমাদের বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
অধ্যাপক নাদির জুনাইদের পর চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল বিভাগটির অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস এবং অধ্যাপক ড. এস এম শামীম রেজার।কিন্তু দায়িত্ব নিতে প্রতিবন্ধকতা কোথায় তা জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. শামীম রেজা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টি সম্পূর্ণ উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এখতেয়ার। তবে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসকে একাধিকবার কল দিয়ে ও বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
বক্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ডিন ও উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সাংবাদিকতা বিভাগে আমার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি একান্তই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত, এটা আমার অতিরিক্ত দায়িত্ব। এর আগে, তৎকালীন ডিন অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ এ দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও কোর্টের ঝামেলা থাকার কারণে উনাকে অ্যাকাডেমিক কাজ থেকে সরিয়ে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়। মূলত উনাকে ঘিরে বিভাগটিতে এ সংকটের সূচনা। আপাতত বিভাগে স্ট্যাবিলিটি (স্থিতিশীলতা) ঠিক রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনুষদ ডিনকে ওখানে রেয়েছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। উপাচার্য মহোদয় বিদেশে আছেন, তিনি দেশে আসলে তার সঙ্গেও বসব।
তিনি আরও বলেন, আমি বিভাগেও আবার কথা বলব। ওখানেও একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। একটা অংশ হয়ত চায়, বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেভাবেই থাকুক, আরেকটা অংশ চায় পরিবর্তন। তবে আমাদের আল্টিমেট গোল (লক্ষ্য) হলো- যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাটা সমাধান করে রেগুলার চেয়ারম্যান নিয়ে আসা।