Image description

অতি মুনাফালোভী ডিলাররা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দামে সার বিক্রি করছে। ফলে চলতি শীত মৌসুমে লালমনিরহাটে সারের সংকট দেখা দিয়েছে। কৃষকের সরকারি ভর্তুকির সার নিয়ে তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। সার বেশি দামে বিক্রি ও জেলার বাইরে করা হচ্ছে পাচারও।

অভিযোগ উঠেছে, সরাসরি কৃষকের কাছে সার বিক্রি করার নিয়ম থাকলেও অসাধু ডিলাররা সার উত্তোলনের পরপরই তা অতিরিক্ত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে গোপনে বিক্রি করে দেন। সার ডিলার ও খুচরা বিক্রেতা মিলে তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। ফলে কৃষকরা ডিলারদের কাছে গিয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার না পেয়ে বাধ্য হয়ে খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্যে সার ক্রয় করছেন। আবার কিছু কিছু ডিলাররা সার গোপন গুদামে মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। আবার কোনো কোনো ডিলার অধিক লাভে জেলার বাইরেও সার পাচার করছেন।

এদিকে, গত শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বাইপাস মোড়ে অবৈধভাবে সার বিক্রির সময় ৪১৬ বস্তা সার জব্দ করে বিসিআইসি সার ডিলারকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার দাশ।

স্থানীয়রা জানান, সার ডিলার ফারুক আহম্মেদ লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগর সরকারি গোডাউন থেকে ইউরিয়া, ডিএপি ও পটাশসহ প্রায় ৭০০ বস্তা সার উত্তোলন করে ট্রাকযোগে পাটগ্রামে আনছিল। পথিমধ্যে ট্রাক থেকে ৪১৬ বস্তা সার উপজেলার ওই বাইপাস মোড়ে নামিয়ে অধিক মুল্যে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। স্থানীয়রা বিষয়টি টের পেয়ে উপজেলা প্রশাসনকে খবর দিলে অভিযান চালিয়ে ওই সার জব্দ করা হয়। একইদিন পাটগ্রাম উপজেলা শহরের সার ব্যবসায়ী হায়দার আলীর দোকানে অভিযান চালিয়ে অবৈধ মজুদ এবং অধিকমূল্যে সার বিক্রির অভিযোগে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এসময় ১৩০০ বস্তা সার জব্দ করা হয়।

এদিকে গত ২৬ সেপ্টেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং জেলা কৃষি বিভাগের যৌথ অভিযানে জেলার বাইরে পাচারের সময় ১৯৩ বস্তা সার জব্দ করা হয়। কিন্তু একমাস পেরিয়ে গেলেও ওই সারের মালিক খুঁজে পায়নি জেলা কৃষি বিভাগ। সদর উপজেলার কুলাঘাট বিজিবি চেকপোস্ট এলাকা থেকে ওই সারগুলো জব্দ করা হয়। যার ১৪২ বস্তা ইউরিয়া ও ৫১ বস্তা ডিএপি সার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সার ব্যবসায়ী জানান, জব্দকৃত সারগুলো প্রভাবশালী এক বিএনপি নেতার।

অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় কৃষি বিভাগ সারসহ আটক লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের শামীম হক ও মজমুল হোসেন এবং কুড়িগ্রাম জেলার রেজাউল করীম ও আবুল কাসেম নামে ৪ টলি চালককে স্থানীয় এক ঔষধের দোকানে নিয়ে রহস্যজনক কারণে শুধু নাম ঠিকানা নিয়ে ছেড়ে দেয়।

জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর এলাকার বিএডিসি (বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন) গুদামে জেলার জন্য বরাদ্দকৃত নন-ইউরিয়া সার টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি সার যথেষ্ট পরিমাণে মজুদ রয়েছে। চলতি অক্টোবর মাসে লালমনিরহাটে টিএসপি বরাদ্দ ১ হাজার ৭১৫ মেট্রিক টন, ডিএপি ৩ হাজার ২৪২ টন ও এমওপি ১ হাজার ৪৪ টন।

বিএডিসি লালমনিরহাট গুদামের সহকারী পরিচালক একরামুল হক কালবেলাকে বলেন, লালমনিরহাটে ১৪৪ জন ডিলারের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত দরে সার বিক্রি হয়। সরকার ডিলারদের কাছে প্রতিকেজি টিএসপি ২৫ টাকা, ডিএপি ১৯ টাকা ও এমওপি ১৮ টাকা দরে বিক্রি করছে। ডিলাররা প্রতিকেজিতে ২ টাকা লাভে কৃষকের কাছে বিক্রি করতে পারবেন। আর সরকার প্রতিকেজি সারে ৫৫ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছেন। কিন্তু ডিলারদের কাছে সার না পেয়ে কেজি প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে সার কিনছেন বলে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন।

জেলার আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের কৃষক আবদুল হাই বলেন, ডিলারদের কাছ থেকে চাহিদামতো সার পাওয়া যায় না। অনেক সময় ভরা মৌসুমেও তারা বলেন, সার শেষ। কিন্তু খুচরা দোকানে গেলে আবার সার পাওয়া যায়। তখন আমাদের বাধ্য হয়েই বেশি সার দাম নিতে হয়।

সদর উপজেলার তিস্তা আনন্দ বাজার এলাকার কৃষক আবদুল করিম জানান, জেলার সার বাইরে পাচার হলে সার সংকট প্রকট আকার ধারন করবে। শীত মৌসুমে সার না পেলে আমাদের শাক সবজিসহ অন্যান্য আবাদে বড় ক্ষতি হবে। আবার নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সারের চাহিদা আরও বেড়ে যাবে।

তবে সার ডিলাররা দাবি করে বলেন, তারা চাহিদার তুলনায় সার কম বরাদ্দ পাচ্ছেন। গুদাম থেকে সার উত্তোলন করে দোকানে আনার এক সপ্তাহের মধ্যেই সব বিক্রি হচ্ছে। কৃষক সার কিনতে এসে না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন। এমনকি অনেক কৃষকের সঙ্গে বাগবিতণ্ডাও হচ্ছে।

লালমনিরহাট জেলা সার ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল হাকিম কালবেলাকে বলেন, তিস্তা ও ধরলা চরাঞ্চলে এখন প্রচুর জমিতে ফসল উৎপাদন হচ্ছে। ফলে সারের চাহিদাও বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় সংকট তৈরি হয়। চাহিদামতো সার সরবরাহ করলে সংকট থাকবে না। তবে কোনো ডিলার কর্তৃক সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে তাকে আইনের আনারও দাবি জানান তিনি।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. সাইখুল আরিফিন কালবেলাকে জানান, সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী সারের কোনো সংকট নেই। কিন্তু কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার লোভে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

তিনি বলেন, নতুন সার নীতি চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী জানুয়ারি থেকে এটা কার্যকর হবে। এতে ডিলাররা কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ পাবে না। তবে সার বাইরের জেলায় পাচার হচ্ছে এবং যব্দকৃত সারের মালিক কেন খুঁজে পাচ্ছেন না—এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দেননি তিনি।