Image description

দুর্ঘটনায় আহত, সন্তান প্রসব, লিউকোমিয়া বা যে কোনো ধরনের অস্ত্রোপচার কিংবা রক্তস্বল্পতার রোগীর জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন হয় রক্তের। একজন থেকে আরেকজনের শরীরে রক্ত পরিসঞ্চালনের সময় যেন কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত না হয়, সেজন্য রক্ত পরীক্ষাও করা হয়। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু। যে ধাতুর প্রভাবে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের কিডনি বিকল, যকৃত অকার্যকর, এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ যৌথভাবে এই গবেষণা করেছে। এ ধরনের গবেষণা দেশে এটিই প্রথম। এতে দেখা গেছে, রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে মানবদেহে অস্বাভাবিক হারে ভারী ধাতু প্রবেশ করে, যা সহনীয় মাত্রার তুলনায় ৭ থেকে ৩০ গুণ পর্যন্ত বেশি। গবেষণার এই ফল আতঙ্কের উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, শিশুদের শরীরে ভারী ধাতু প্রবেশ করলে তাদের মানসিক বিকাশ মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হয়। সাধারণ জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

বিসিএসআইআরের সেন্ট্রাল অ্যানালেটিক্যাল অ্যান্ড রিসার্চ ফ্যাসিলিটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মনিরুজ্জামান, কুতুব উদ্দিনসহ কয়েকজন গবেষক এই কাজে সহযোগিতা করেন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক গবেষণায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

গবেষণায় যা পাওয়া গেছে: গবেষণায় মোট ১৪টি ভারী ধাতুর উপস্থিতি দেখা হয়েছিল। এগুলো হলো—সিসা, আর্সেনিক, ব্রেলিয়াম, ক্যাডমিয়াম, কোবাল্ট, ক্রোমিয়াম, কপার বা তামা, পারদ, ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, সেলেনিয়াম, ভানাডিয়াম ও জিঙ্ক বা দস্তা।

গবেষণায় ১০০ জনের নমুনা নেওয়া হয়। এসব নমুনা রোগী এবং তাদের রক্তদাতা থেকে সংগৃহীত। রোগী বলতে যারা প্লাস্টিক সার্জারি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন; অন্য কোনো রোগ নিয়ে ভর্তি ছিলেন না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রক্তদাতাদের নমুনা নেওয়া হয়। এর মধ্যে জয়পুরহাট, রাজশাহী, বরিশাল, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ইত্যাদি এলাকার লোক ছিলেন। গবেষণায় যাদের রক্তের নমুনা নেওয়া হয়েছে, তাদের বয়স সর্বনিম্ন এক বছর এবং সর্বোচ্চ ৭২ বছর।

গবেষণায় প্রাপ্ত উপাত্তে আর্সেনিকের গড় উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৭ দশমিক ৭৫ মাইক্রোগ্রাম। যেখানে মানবদেহে এই ধাতুর সহনীয় মাত্রা ১ মাইক্রোগ্রামের কম। সিসা বা লেডের গড় উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৭৩ দশমিক ৩৫ মাইক্রোগ্রাম, যেখানে সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৩৫ মাইক্রোগ্রাম। ক্যাডমিয়ামের গড় উপস্থিতি ১ দশমিক ২৪ গ্রাম, সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ৩৫ মাইক্রোগ্রাম। ক্রোমিয়ামের গড় উপস্থিতি ২৯৫ দশমিক ৬৩ মাইক্রোগ্রাম, সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ১০ থেকে শূন্য দশমিক ১৬ মাইক্রোগ্রাম। নিকেলের গড় উপস্থিতি ৭২ দশমিক ৪৪ মাইক্রোগ্রাম, সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম। পারদ বা মার্কারির গড় উপস্থিতি ১৬ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, সহনীয় মাত্রা ১০ মাইক্রোগ্রামের নিচে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, এই গবেষণায় আমরা দেখাতে চেয়েছি, রক্ত পরিসঞ্চালনের পর শিশুদের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন হতে পারে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, রক্ত গ্রহণের ফলে শরীরে ভারী ধাতুর পরিমাণ বাড়ে। অর্থাৎ ভারী ধাতু রক্তের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের শরীরে প্রবেশ করে। তবে গবেষণায় সীমাবদ্ধতা হলো ভারী ধাতুগুলো রোগীর শরীরে কী কী প্রভাব ফেলছে বা রক্তদাতার রক্তে ভারী ধাতু হ্রাস পায় কি না, তা জানা যায়নি।

তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এক বছরের শিশুর রক্তে অত্যধিক পরিমাণ ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। সেটি কীভাবে এলো, তা পরবর্তী গবেষণার বিষয়। শুধু ঢাকার ভেতরে থাকার কারণেই ভারী ধাতুর ঝুঁকি বাড়ছে তা নয়, সমগ্র বাংলাদেশই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যেহেতু পরিবেশের পরিবর্তন অতি দ্রুত সম্ভব নয়, তাই নজর দেওয়া উচিত কীভাবে রক্ত বা শরীর থেকে এসব ধাতু কমিয়ে ফেলা যায়। আমরা অনেক রোগই দেখছি, যেগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা করার পরও আরোগ্য মিলছে না। সেগুলোর সঙ্গে ভারী ধাতুর সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা জানাটা জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারে ভারী ধাতুর উপস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর দূষণ। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণে অন্যান্য জটিলতার মতো খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাতাসে ভাসমান নানা পদার্থ সহজেই মানুষের প্রাত্যহিক খাদ্যে মিশে যাচ্ছে। এ ছাড়া খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক ও কীটনাশক মাটির উর্বরা শক্তি কমিয়ে মাটিকে দূষিত করছে।

বাংলাদেশে বিপুল জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা মেটাতে বাণিজ্যিকভাবে মুরগির উৎপাদন লক্ষ্য করা যায়। অন্য এক গবেষণায় উৎপাদিত মুরগির মাংসে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, পারদ, নিকেল ও সিসার মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি করে। এসব ধাতু মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি এক-চতুর্থাংশ বাড়িয়ে দিতে পারে।

এ দেশে উৎপাদিত মৎস্য শিল্পেও একই অবস্থা বিদ্যমান। বর্তমানে দেশে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য আহরণের পাশাপাশি খামারে মাছচাষের পদ্ধতি চালু রয়েছে। কিন্তু মাছের খাদ্যে ভেজালসহ নানা কারণে উৎপাদিত মাছে ভারী ধাতুর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।

মানবদেহে ভারী ধাতুর প্রভাব: সীসা মানুষের মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতিসহ ক্যান্সার এবং মিউটাজেনেসিস ইত্যাদির কারণ হয়। সিসা একটি বিষাক্ত ভারী ধাতু। সেটি মানবদেহে প্রবেশ করলে নির্মূল করা কঠিন। মানুষের মস্তিষ্কেও কোষের সরাসরি ক্ষতি করে। বিশেষ করে ভ্রূণের স্নায়ু, জন্মগত মস্তিষ্কের সালকাস অগভীর এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সিসা বয়স্কদের ডিমেনশিয়া এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে পারে।

ক্রোমিয়াম অঙ্গের অসাড়তা এবং মানসিক ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে। আর্সেনিক ত্বকের পিগমেন্টেশন হতে পারে এবং অস্বাভাবিক কেরাটিনাইজেশন ঘটাতে পারে। ক্যাডমিয়াম উচ্চ রক্তচাপসহ কার্ডিওভাসকুলার এবং সেরিব্রোভাসকুলার রোগের কারণ। এ ছাড়া হাড়ের ক্যালসিয়াম ধ্বংস করে এবং রেনাল ডিসফাংশন ঘটায়। অ্যালুমিনিয়াম দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকে, যা শিশুদের মানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মধ্যবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি হ্রাস করে এবং বয়স্কদের মধ্যে ডিমেনশিয়া সৃষ্টি করে।

এই ভারী ধাতুগুলোর যে কোনো একটি মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, অনিদ্রা, ভুলে যাওয়া, বিভ্রান্তি, জয়েন্টে ব্যথা, পাথর, ক্যান্সার (যেমন লিভার ক্যান্সার, পাকস্থলীর ক্যান্সার, অন্ত্রের ক্যান্সার, মূত্রাশয় ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার) হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক বলেন, আমাদের পরিবেশে হেভি মেটাল বা ভারী ধাতুর উপস্থিতি যত্রতত্র। মাটি, পানি, বাতাসের মাধ্যমে এসব ভারী ধাতু ফল ও ফসলে, পশুপাখির শরীরে প্রবেশ করে, যা পরবর্তী সময়ে মানবদেহে প্রবেশ করে নানা রোগব্যাধী সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতিসাধন করে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জনস্বাস্থ্য রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।