পাসপোর্ট অফিস ঘিরে একসময় অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর দালালদের দৌরাত্ম্যে সেবাগ্রহীতা নানা বিড়ম্বনার শিকার হতেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পর এখানে সেবার মান কিছুটা বেড়েছে। শুধু আড়ালে থেকে দালালচক্র এখনো সেবাপ্রার্থীদের বিব্রত করছে।
গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ডিভিশনাল পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, আফতাবনগরে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে (ঢাকা পূর্ব) এবং যাত্রাবাড়ীতে একটি ভাড়া বাড়িতে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সরেজমিনে গিয়ে পাসপোর্ট সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে নানা অভিযোগের পাশাপাশি কিছুটা সেবা পাওয়ার তথ্যও পাওয়া যায়।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ টি এম আবু আসাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দালালের দৌরাত্ম্য হয়তো রয়েছে, তবে সেবা সহজ করতে আমরা প্রধানত দালাল নির্মূলের উদ্যোগ নিয়েছি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন দালালকে আটক করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। আর কোনো দালাল যাতে পাসপোর্ট ভবনে এসে মানুষকে হয়রানি করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রয়েছে আমাদের।’
দালালের উৎপাত থেকে সেবাগ্রহীতাদের স্বস্তি দিতে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত আনসার ও এপিবিএন সদস্য। ভবনে দালালের প্রবেশ ঠেকাতে পাসপোর্ট অফিসগুলোতে কিছুক্ষণ পর পরই সেনা সদস্যদের নজরদারি করতে দেখা গেছে। ভবনের বাইরে টহল দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।
আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের চালচিত্র
গতকাল রবিবার সরেজমিনে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্ট ভবনের সামনে নেই চিরচেনা দীর্ঘ লাইন। ভবনের নিচের করিডরে সেবাগ্রহীতাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সেবাগ্রহীতাদের জন্য দুটি ভিন্ন্ন কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে একাধিক বুথ।
পাসপোর্ট বানাতে ও নবায়ন করতে আসা মানুষ অনেকটা ভোগান্তি ছাড়াই সেবা নিয়ে ফিরছেন। তবে আবেদন ও যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার জটিলতায় সেবা প্রদানে ধীরগতি থাকায় কিছুটা ভোগান্তি রয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন সেবাগ্রহীতারা।
কিশোরগঞ্জ থেকে পাসপোর্ট নবায়ন করতে আসা মো. জনি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে সৌদিতে একটা কম্পানিতে চাকরি করতাম। ওই কম্পানি আবার আমারে জরুরি ভিত্তিতে ডেকেছে।
দুই বছর দেশে দোকান করি, কইতেও পারি না পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। ভাবলাম দালাল ধরতে হইব, ট্যাকা যাইব। আইসা দেখি সব অটো সিস্টেম, সেবা ভালো।’
তবে পাসপোর্ট আবেদন ও যাচাইকরণ প্রক্রিয়া এবং অনলাইন সেবা সংক্রান্ত জটিলতায় সেবা প্রদানে ধীরগতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সেবাগ্রহীতারা। তাঁদের অভিযোগ, অনলাইন আবেদনপত্রের সঙ্গে যে কাগজপত্র জমা দেওয়ার কথা, এর বাইরেও অনেক কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে, যেগুলোর উল্লেখ ছিল না।
নতুন পাসপোর্ট করতে আসা রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম জানালেন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়টি, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁরা ক্লিয়ারেন্স পাঠিয়েছেন। আমি কোনো মেসেজ পাইনি। এখানে এসে জানতে পারলাম, ক্লিয়ারেন্স পাঠানো হয়নি। এখানকার অফিসাররা বলছেন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।’
আফতাবনগর পাসপোর্ট অফিসে ভোগান্তি নেই
রাজধানীর আফতাবনগরে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে (ঢাকা পূর্ব) সকাল ১১টায় গিয়ে দেখা যায়, তৃতীয় তলা পর্যন্ত সেবাপ্রার্থীরা সেবা নিচ্ছেন। লাইনে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা ভোগান্তি চোখে পড়েনি। সেবাপ্রার্থীদেরও আনাগোনা খুব বেশি ছিল না। বর্তমানে এই অফিস থেকে গড়ে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ পাসপোর্ট ডেলিভারির কাজ হয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা শফিক রহমান বলেন, ‘কোনো ধরনের দালাল এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ঘুষ ছাড়াই যথাসময়ে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছি। আগের চেয়ে পাসপোর্ট অফিসে স্বচ্ছতা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
সার্বিক বিষয়ে আফতাবনগর পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তাজ বিল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিকেন্দ্রীকরণের কারণে আগের মতো লম্বা লাইন ও ভোগান্তি নেই। ঢাকায় আরো চারটি অফিসের প্রস্তাব রয়েছে, সেগুলো হলে রাজধানীবাসী আরো সুফল পাবেন।
যাত্রাবাড়ীতে নেই দালালের তেমন উৎপাত
আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের চাপ কমানোর জন্য ২০১০ সালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি ভাড়া বাড়িতে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস যাত্রাবাড়ী নামে একটি অফিস চালু করা হয়। গতকাল সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্টপ্রত্যাশীদের সময়োপযোগী সেবা দিতে পারছেন না অফিসে কর্তব্যরত লোকজন। এখানে পাসপোর্টপ্রত্যাশীদের চরম ভোগান্তির কথা জানা গেল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাইম, ফয়সাল, রাসেল, রফিক, রায়হানসহ আট-দশজন দালাল এখনো এখানে সক্রিয়। তবে গোপনে কাজ করে তারা।
রাজধানীর জুরাইন এলাকা থেকে আসা মো. সাইদুল বলেন, ‘আমার আগের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হলে আমি নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছি। ২০-২৫ দিনের মধ্যে মেসেজ পাওয়ার কথা, কিন্তু আজ আড়াই মাস পার হলেও আমার কোনো মেসেজ আসেনি।’
আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস যাত্রাবাড়ীর পরিচালক মেহের উদ্দিন বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগের অবস্থা এখন আর নাই। আপনারা নিজে ঘুরে দেখেন কোনো দালাল আছে কি না।’