Image description

জুলাই জাতীয় সনদসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। এবার তিনটি দল উপদেষ্টা পরিষদের কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে নতুন বিতর্ক উসকে দিয়েছে। এতে অস্বস্তিতে পড়েছেন উপদেষ্টাদের কেউ কেউ।

সরকারের কোন কোন উপদেষ্টার বিষয়ে আপত্তি আছে, তা কোনো রাজনৈতিক দলই প্রকাশ্যে বলেনি। তবে উপদেষ্টা পরিষদ ও রাজনৈতিক মহলে মোটামুটি সাত-আটজনের নাম আলোচিত হচ্ছে।

সড়ক পরিবহন, রেল ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত শুক্রবার ফেসবুকে বিষয়টি লিখেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন রাজনৈতিক দলের বৈঠকে উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। একটি দলের তালিকায় আমার নামও আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে শুধু এটুকুই বলা যে আমি পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তা করতে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত নই। সব সময় কোনো রকম অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

শুরুতে উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বড় কোনো প্রশ্ন তোলেনি। কয়েকজন উপদেষ্টার দপ্তর বদল ছাড়া পরিষদে তেমন কোনো পরিবর্তনও আসেনি। দুজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাকে নিয়ে বিএনপি গত মে মাসের দিকে প্রশ্ন তোলা শুরু করে।

ফাওজুল কবিরের পরামর্শ হলো, প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বিশেষ সহকারী এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কোনো লাভজনক পদে অংশ নিতে পারবেন না—এই মর্মে একটি অধ্যাদেশ জারি করলে বিষয়টির সুরাহা হতে পারে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৩ জন। উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে তখন বিভিন্ন দলের কাছ থেকে নাম নেওয়া হয়েছিল। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে শুরুতে স্থান পেয়েছিলেন দুজন।

শুরুতে উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বড় কোনো প্রশ্ন তোলেনি। কয়েকজন উপদেষ্টার দপ্তর বদল ছাড়া পরিষদে তেমন কোনো পরিবর্তনও আসেনি। দুজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাকে নিয়ে বিএনপি গত মে মাসের দিকে প্রশ্ন তোলা শুরু করে।

উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য জোরালোভাবে আসে চলতি মাসে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের (নিরাপদ প্রস্থান) কথা ভাবতেছে।’

পরদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীও সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ করে। জামায়াত কারও নাম উল্লেখ করেনি। এ

১৪ অক্টোবর ঢাকায় এক মানববন্ধনে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, কোন কোন উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাঁদের নাম ও কণ্ঠ রেকর্ড আছে। জামায়াতের এই নেতা আরও দাবি করেন, সরকারের চার-পাঁচজন উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে সব নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ‘দলঘনিষ্ঠ’ উপদেষ্টাদের বাদ দেওয়ার কথা বলে বিএনপি। দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা নিয়ে তাদের অভিযোগ আগে থেকেই ছিল। এবার তারা অন্য একজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি করেছে।

পরদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীও সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ করে। জামায়াত কারও নাম উল্লেখ করেনি। একই দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদা বৈঠকে এনসিপি নেতারা প্রয়োজন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নন, বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী উপদেষ্টাদের বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছেন।

তিন দলের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থান উপদেষ্টা পরিষদের কোনো কোনো সদস্যের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করে। সরকারের একজন উপদেষ্টা গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, দলগুলোর এমন অভিযোগ বিব্রতকর। এসব অভিযোগের সঙ্গে সত্যতার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা নিজেদের সুবিধা আদায়ের কৌশল হিসেবে এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে। কিন্তু মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে।

উপদেষ্টা পরিষদের কেউ কেউ মনে করছেন, অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দলগুলোর পছন্দ হয়নি বলেই তারা উপদেষ্টাদের চাপে রাখতে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করছে।

দলগুলোর এই অবস্থান কেন

সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্র বলছে, জনপ্রশাসন, পুলিশ, আদালত এবং জেলা পর্যায়ে সরকারের আইন কর্মকর্তা নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে শুরু থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। বিশেষ করে জনপ্রশাসন ও পুলিশে নিজেদের পছন্দের লোক বসাতে তৎপর ছিল দল দুটি।

সর্বশেষ জনপ্রশাসন সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) পদে বদলি নিয়ে দুই দল বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে গত মাসের শেষের দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে ওই পদে তাদের পছন্দের একজনকে দায়িত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়, যিনি জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে। ফলে তাঁকে জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পরে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এহসানুল হককে এক মাস পর এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর বিষয়ে অবশ্য বিএনপির আপত্তি করেনি।

শুধু জনপ্রশাসন সচিব নন, জনপ্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে নাম দেওয়া হয়। তাদের পছন্দমতো নিয়োগের চাপ আসে। উপদেষ্টা পরিষদের কেউ কেউ মনে করছেন, অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দলগুলোর পছন্দ হয়নি বলেই তারা উপদেষ্টাদের চাপে রাখতে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করছে।

অন্যদিকে এনসিপি শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। দলটিকে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে শাপলা দেয়নি নির্বাচন কমিশন। সরকারের ওপর দলটির প্রভাব কমে গেছে বলে মনে করছেন এনসিপির নেতারা। সূত্র বলছে, দলটির নেতা শাপলা প্রতীক আদায় এবং ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাদের এখনই যাতে পদত্যাগ করতে না হয়—সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই অন্য কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছেন।

আমরা এগুলো নিয়ে নিজেরা নিজেরা কথা বলি, আর ভাবি যে আসলে ওনারা কী বলতে চান। খুশি থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে এ ধরনের দাবি করেন। আমরা এগুলো নিয়ে বিচলিত না। আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি বেঁচে যাব—এ রকম একটা অবস্থায় আছি।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

সরকারের অবস্থান কী

বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি করেছে, তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত। দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, উপদেষ্টাদের নিয়ে দলগুলোর বক্তব্যকে রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি হিসেবেই দেখছে সরকারের উচ্চপর্যায়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টাদের কাজ করে যাওয়া এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গত বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা এগুলো নিয়ে নিজেরা নিজেরা কথা বলি, আর ভাবি যে আসলে ওনারা কী বলতে চান। খুশি থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে এ ধরনের দাবি করেন। আমরা এগুলো নিয়ে বিচলিত না। আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি বেঁচে যাব—এ রকম একটা অবস্থায় আছি।’