Image description

বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ও বার্থী ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের বাসিন্দাদের চোখেমুখে এখন শুধুই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এসব গ্রাম থেকে একে একে ‘নিখোঁজ’ হওয়া তরুণদের পরিবারের এই উৎকণ্ঠা বাড়ছেই। ‘নিখোঁজ’ তরুণদের কেউ কারোর সন্তান, কেউ আবার কারোর স্বামী, কেউ কারোর আপন ভাই। তরুণদের স্বপ্ন ছিল ইতালির উজ্জ্বল আকাশে উড়বে নিজের ভাগ্যের নতুন রং।

তবে সেই স্বপ্ন ছিল একটা ফাঁদ। স্বপ্নের ফাঁদ তাঁদের নিয়ে গেছে লিবিয়ার মরুভূমি পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরের মৃত্যুযাত্রায়। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, শুধু বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার কমপক্ষে ৫৬ জন লিবিয়ায় দুর্গম স্থানে বন্দি থেকে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন।

গৌরনদীর মানুষজন এখন যে রুটের নাম শুনলেই শিউরে ওঠে, সেটি লিবিয়া টু ইতালি রুট।

গ্রামের চায়ের দোকানে, হাটের আড্ডায়, মসজিদের বারান্দায় ইতালিপ্রবাসী জাকির মোল্লার নাম আলোচিত হচ্ছে। কারণ এই জাকিরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা চক্রের ফাঁদে পড়েই তরুণরা নিখোঁজ হচ্ছেন। অনেকের বন্দি থাকার তথ্য মিলছে। উপজেলার পশ্চিম ডুমুরিয়ায় জাকিরের বাড়ি।
 
জাকির মোল্লা তরুণদের পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন, অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে এই ৫৬ জনকেও অপহরণ করা হয়েছিল। এখন তাঁরা লিবিয়ায় রয়েছেন। তাঁরা চাইলে দেশে ফিরতে পারবেন। চাইলে ইতালি পাঠিয়ে দেওয়া হবে অবৈধ পথে। ইতালিতে পৌঁছানো কয়েকজনের সাফল্যের গল্পই ছিল ফাঁদ।
দালালরা বলেছে, ছয় মাসেই কাজের পারমিট মেলে, কেউ আবার আশ্বাস দিয়েছে তিন বছরের মধ্যে নাগরিকত্ব মিলবে। সেই আশায় বরিশাল জেলার গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, ছাড়াও মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের শতাধিক তরুণ শেষ সম্বলটুকু তুলে দিয়েছিলেন দালালদের হাতে। অনেকে গরু বিক্রি করেছেন, কেউ বন্ধক রেখেছেন জমি। কিন্তু ইউরোপের আকাশ দেখা হয়নি তাঁদের কারোর। পথে ধরা পড়ে বন্দি হয়ে আছেন কেউ কেউ। লিবিয়ায় দালালের জিম্মায় থাকা একাধিক তরুণের পরিবারের সঙ্গে গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের এ প্রতিনিধির কথা হয়েছে। এই পরিবারের সদস্যরা তরুণদের না পেয়ে এখন দিশাহারা। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, সব কিছুই ছিল দালালচক্রের সুচিন্তিত ছক। প্রথম ধাপে ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব, সেখান থেকে ট্যুরিস্ট ভিসায় মিসর, পরে তিন মাসের ট্যুরিস্ট ভিসায় লিবিয়া পৌঁছে তারপর সেখান থেকে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে ২৫ বছরের কম বয়সী তরুণদের লিবিয়া পাঠানো হয় শ্রীলঙ্কার পথ দিয়ে। লিবিয়ায় পৌঁছার পর সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় গোপন আস্তানায়।  স্থানীয় ভাষায় তার নাম রিসিভ হাউস। সেখানে পৌঁছানোর আগেই দিতে হয় পাঁচ লাখ টাকা অগ্রিম। এরপর শুরু হয় অপেক্ষা। আরো ১০ থেকে ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করলে তবেই সুযোগ মিলবে গেইমে ওঠার। লিবিয়ার দালালদের কাছে এই গেইম শব্দের মানে হলো মৃত্যু। দালালরা এই সমুদ্রযাত্রাকে খেলার মতো দেখাতে চায়, কিন্তু বাস্তবে এটি এক ভয়ংকর পথ। কারণ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় জীবন বারবার ঝুঁকিতে পড়ে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অনেকের নৌকা ডুবে যায়, কেউ ধরা পড়েন কোস্ট গার্ডের হাতে, আর অনেকেই হারিয়ে যান সাগরের ঢেউয়ে। সংশ্লিষ্ট লোকজনের কাছ থেকে আরো জানা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তরুণদের। তাতে কিভাবে ঢেউ সামলাতে হয়, ওয়াকিটকি চালাতে হয় কিংবা স্পিডবোটে দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রাখতে হয়, সেগুলো শেখানো হয়। যাঁদের আগে ওমানে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের হাতে দেওয়া হয় বোটের হাল। ৩২ থেকে ৩৮ যাত্রীতে ঠাসা প্রতিটি বোটে থাকেন তিনজন চালক। তাঁরাই আবার গাইড হিসেবে কাজ করেন। খাবার হিসেবে থাকে শুকনা রুটি, খেজুর ও সামান্য পানি। কোমরে বাঁধা থাকে প্যাম্পার্স, যাতে টয়লেট করতে গিয়ে কেউ সাগরে পড়ে না যান বা রাক্ষুসে মাছের শিকার হলেও নিজেদের বাঁচাতে পারেন।

গত ৮ ও ২২ সেপ্টেম্বর রাতে লিবিয়ার বেনগাজি উপকূল থেকে তিনটি স্পিডবোট একসঙ্গে রওনা হয় ইতালির দিকে। বোটগুলোতে ছিলেন বরিশালের গৌরনদীর ৫৬ ও আগৈলঝাড়ার ১০ এবং অন্যান্য জেলার ৩৮ জন। জানা গেছে, জাকির মোল্লা, বগুড়ার সাজু ও কুষ্টিয়ার লিটন ইতালি অবস্থান করে চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে অভিযান সমন্বয় করেন। কিন্তু ১৭ ঘণ্টার মাথায় থেমে যায় সব স্বপ্ন। ভয়ংকর ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই চলার মধ্যেই লিবিয়ার কোস্ট গার্ড সদস্যদের টহল বোট ঘিরে ফেলে এসব বাংলাদেশিকে। তিনটি বোটের সবাইকে করা হয় আটক। পরদিন খবর আসে ৩২ জনকে নেওয়া হয়েছে গাম্মুদা এলাকায়। আর প্রথম বোটের ৩৮ জন গৌরনদীবাসীর আর কোনো খোঁজ নেই। তাঁদের কাউকে কাউকে রাখা হয়েছে সিসিলি দ্বীপে।

এরপর আসে আরো এক টুকরা কাগজের চিরকুট। ১০ অক্টোবর বন্দিদের পাঠানো সেই চিরকুটে লেখা ছিল, আমরা গৌরনদীর ছেলে। তিনটি স্পিডবোট থেকে আটক হয়েছি। দিনে একবার ৭০ গ্রাম খাবার দেওয়া হয়। পানির তীব্র সংকট। আমরা বাংকিনা কারাগারের পাশে এক গোডাউনে বন্দি। অর্ধাহারে দিন কাটছে। বাঁচাও মা। চিরকুটটি গৌরনদীতে পৌঁছানোর পর গ্রামজুড়ে নেমে আসে মাতম। মেহেদী হাসান নামে এক তরুণের মুক্তির খবর আসে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে। তাঁর ভগ্নিপতি ইতালিপ্রবাসী নোমান মাঝি, কোনোভাবে যোগাযোগ করে টাকা পাঠান দালালদের কাছে। মেহেদীর পরিবারের সঙ্গে তাঁর ভিডিও কলে কথা বলার দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু সেই খবরই উসকে দেয় অন্যদের ক্ষোভ।

গত ২১ সেপ্টেম্বর সকালে পশ্চিম ডুমুরিয়ায় জাকির মোল্লার বাড়ির সামনে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে নিখোঁজদের স্বজনরা। কান্নায়, রাগে, হতাশায় তারা ঘেরাও করে বাড়িটি। জাকিরের মা নুরজাহান বেগম তখন বলেন, আমার ছেলে টাকা দিয়ে ৫৬ জনকে ছাড়িয়ে এনেছে। কিন্তু স্থানীয়দের বক্তব্য ভিন্ন, আগেই মুক্তিপণের নামে টাকা নিয়েছিল তারা। এখন আবার নতুন নাটক করা হচ্ছে।

তরুণদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মানবপাচারের এই নেটওয়ার্কের শিকড় ছড়িয়েছে বহুদূর। প্রত্যেক অভিবাসীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা। বাংলাদেশে থাকা দালালরা টাকা পাঠিয়েছে লিবিয়ার বেনগাজির ঘাঁটিতে। কেউ নিয়েছে বোর্ডিং ফি, কেউ দিয়েছে কারাগার ম্যানেজ বাবদ খরচ। সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে মিসরসহ সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে এই দালালচক্র। খাঞ্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরু আলম সেরনিয়াবাত বলেন, বহু যুবক আটক আছেন, খবর আমরা পাচ্ছি। কিন্তু পরিবারগুলো মামলা করতে ভয় পাচ্ছে। মামলা করলে লিবিয়ায় থাকা আত্মীয়রা বিপদে পড়বে। এই ভয়কে পুঁজি করে চলছে মানবপাচারের ব্যবসা। গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইব্রাহিম বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধে আমরা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছি। ভুক্তভোগীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। শনাক্ত করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এরপর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।