নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ তত সামনে চলে আসছে। বিভিন্ন জোটের রূপরেখা নিয়েও চলছে বিস্তর আলোচনা। যেসব ছোট দল দীর্ঘদিন যুগপৎ আন্দোলন করছে, জোট থেকে তাদের কতটা আসন ছাড় দেওয়া হবে, তা নিয়েও আলোচনা জমে উঠেছে। তবে জোটের শরিক দলগুলোকে যে কয়টি আসনই ছাড়া হোক না কেন, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে তারা।
বিশেষ করে মার্কা নিয়ে সবচেয়ে বড় চিন্তায় পড়েছে জোটের শরিক দলগুলো।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘যদি নির্বাচনী জোট হয়, তাহলে জোটের অংশ হলেও দলের যে প্রতীক, তা দিয়ে নির্বাচন করতে হবে, যাতে ভোটাররা ক্লিয়ার আইডিয়া পান, সে কোন দলের।’ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি বিভিন্ন রাজনৈতিক জোটের শরিক দলগুলোর কাছে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ অনেক প্রার্থীই একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান বা শীর্ষ নেতা হলেও এলাকায় তাঁদের তেমন জনপ্রিয়তা নেই। আবার নামে চিনলেও তাঁর দলের প্রতীক কেউ চেনে না। ফলে ওই দলের জন্য জোট থেকে আসন ছাড়লেও নিজস্ব প্রতীকে তাঁর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, যা ওই জোটের জন্যও চিন্তার বিষয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে অন্তত চারটি জোট গঠনের তৎপরতা চলছে।
এবার কোনো দলের এককভাবে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। দেশের বৃহৎ দল বিএনপি তাদের সমমনা দল নিয়ে একটি বড় জোট করতে পারে। পাশাপাশি কয়েকটি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতাও হতে পারে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামী দলগুলোর পৃথক জোট হতে পারে।
কয়েকটি দল নিয়ে এনসিপিরও জোট গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে।
আবার তারা অন্য কোনো জোটের সঙ্গেও যেতে পারে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতৃত্বেও বাম ও সমমনা দলগুলোর একটি জোট গঠনের তৎপরতা আছে।
গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে নির্বাচন ও প্রার্থী তালিকার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বিএনপির জোট গঠনের ব্যাপারেও আলোচনা হয়। এরই মধ্যে জোট বা সমমনা দলের পক্ষ থেকে ২৪৪টি আসনের তালিকা বিভিন্নভাবে বিএনপির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, জোটের যেসব প্রার্থী নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়, যাঁদের আসন ছেড়ে দিলে তাঁরা পাস করতে পারবেন, তাঁদেরই যেন আসন ছাড় দেওয়া হয়। বিগত দিনে যাঁরা বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, তাঁদের মূল্যায়ন করার পক্ষে বিএনপি। কিন্তু মূল্যায়ন করতে গিয়ে যেন কোনোভাবে আসনটি হাতছাড়া না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার ব্যাপারেও আলোচনা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত দিনে যাঁরা আমাদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, তাঁদের অবদানকে আমরা কোনোভাবেই ছোট করে দেখছি না। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের ভোটে কে জিতল, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা আসন চাচ্ছেন তাঁদের বুঝতে হবে, যিনি যে আসন চাচ্ছেন, সেখানে তাঁর অবস্থান এবং বিএনপির যিনি প্রার্থী আছেন, তাঁর অবস্থান কেমন। কার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি আছে। যিনি মনোনয়ন চান, তাঁর স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ বেশি বিবেচনায় নিতে হবে। তাহলে সবাই উপকৃত হব। আমরা আসন ছেড়ে দিলাম, কিন্তু যাঁকে ছাড়লাম, তিনি বিজয়ী হতে পারলেন না। তিনি হারলে আমাদের শত্রুপক্ষ বিজয়ী হবে। এটি সবার জন্যই খারাপ হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জানান, সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত করতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের শেষে বা আগামী মাসের শুরুতে প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করতে চায় বিএনপি। তবে সভায় দুই ধরনের বিষয় তুলে ধরেছেন কমিটির সদস্যরা। স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য প্রস্তাব দেন শরিকদের যেসব আসন ছেড়ে দেওয়া হবে, সেগুলো বাদ রেখে বাকিগুলোতে প্রার্থী ঘোষণা দেওয়ার। আবার আরেকটি অংশ প্রস্তাব দেয় প্রাথমিকভাবে শুধু বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করতে। এরপর জোটের নেতাদের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা শেষে ওই আসনগুলো ছাড় দেবে বিএনপি।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরিকদের ৫৮ আসনে ছাড় দিয়েছিল বিএনপি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ২২ আসন এবং অন্যদের ৩৬ আসন ছাড় দেয় দলটি। সূত্র মতে, এবার জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করবে না বিএনপি। তাই অন্য মিত্র দলগুলোর নেতাদের নিজ আসনে জনপ্রিয়তা কেমন, সেই খোঁজ নিচ্ছে দলটির একাধিক টিম।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, শরিকদের ৪০টির মতো আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আপাতত নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। তবে শরিক দলগুলোর নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় ব্যক্তি বা নিজ দলীয় শক্তিতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম দেখছে তারা। এ ছাড়া প্রতিটি এলাকায়ই দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, নেতাকর্মীদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, তাদের পাশে থেকেছেন। অনেকে নিজ নিজ এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয়। তাঁরা অনেকেই বিএনপির প্রার্থী হতে চান। এসব আসন শরিকদের ছেড়ে দিলে দলের তৃণমূলে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। আবার জোটের শরিকরা নিজস্ব মার্কায় নির্বাচনে অংশ নিলে এলাকার জনগণ কিভাবে নেবে, সেটাও ভাবনার বিষয়।
জানা যায়, একাধিক দলকে জোটে নিতে চায় বিএনপি। বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনে যেসব দল আলোচনায় আছে সেগুলো হলো লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ এলডিপি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সমমনা দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশ লেবার পার্টিসহ একাধিক দল। এ ছাড়া এনসিপি নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রার্থীদের তালিকা দিয়েছি। জোটের অন্যান্য দলও তাদের তালিকা দিয়েছে। আমরা অনিবন্ধিত দল, ফলে আমরা জোটের প্রার্থী হলে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে বাধা নেই। কিন্তু যারা নিবন্ধিত দল, তারা টেনশনে আছে। তাই জোটের শরিক দল হিসেবে আমাদের দাবি ছিল, জোট অথবা দল এর মধ্যে যেকোনো একটার প্রতীক নিয়ে যেন নির্বাচনের সুযোগ রাখা হয়।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ দু-তিনটির বেশি প্রতীক চেনে না। ফলে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে গেলে কিছুটা প্রভাব তো পড়বেই। আমাদের প্রতিবেশী দেশেও কিন্তু জোট অথবা দল যে কারো প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে। তবে আমাদের দেশে যদি সেই সুযোগ রাখা না হয়, তাহলে আমাদের তো একটা করণীয় ঠিক করতে হবে। সেটা আমরা আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করব।’
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীরও একটি বড় জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে নানা দাবিতে জামায়াতসহ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাগপা অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন করছে। তারা একসঙ্গে জোট করে নির্বাচন করতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এর বাইরে আরো কিছু দল তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, এনসিপিও শেষ পর্যন্ত নিজেরাই জোট গঠন করতে পারে। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গেও আসন সমঝোতা হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। জানা গেছে, এনসিপি জোট গঠন করলে তাতে এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি দলকে দেখা যেতে পারে।
নির্বাচনের আগে বামধারার সব দল ও সংগঠনকে নিয়ে একটি জোট গঠনে তৎপর রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এই জোটে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ছয় দল—বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, সমাজতান্ত্রিক পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ থাকছে। এর বাইরে আদিবাসী সংগঠন, দলিত সংগঠন এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে।