Image description
জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৬

রাজশাহী অঞ্চল (বিভাগ) বরাবরই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের দূর্গ হিসাবে পরিচিত। বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের আঘাত সেই দূর্গেও লেগেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধের বিশ্বাসী শহীদ জিয়া বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপি। অন্যদিকে এ অঞ্চলের ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের টার্গেট করে ফাঁকা মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জামায়াত। তাদের পুঁজি ‘আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন চাই’। ইসলামের নামে এমন বড়ি সাধারণ মানুষকে গিলাচ্ছে জামায়াত-শিবির, মহিলা জামায়াত আর অঙ্গ সংগঠনগুলো কোমর বেঁধে মাঠে।

বিপরীতে সবচেয়ে বড় দল বিএনপি এখনো তাদের সাংগঠনিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং আর কোন্দল, নিজ-কেন্দ্রিক রাজনীতি। নির্বাচনে এখনো প্রার্থী দিতে না পারা মাঠ পর্যায়ে বড় শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে জামায়াত। বিএনপির বিরুদ্ধে সব ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিএনপি অতীতের ঘাঁটি মনে করে বসে আছে, কিন্তু বাস্তবে পথ মসৃণ নয়।

১৬ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেনি, ভুলে গেছে ধানের শীষের কথা। আগে যেমন বেগম খালেদা জিয়া যার হাতে ধানের শীষ তুলে দিয়েছেন, সেই বিজয়ী হয়েছে সেদিন এখন আর নেই। বিএনপির অনেক কট্টর সমর্থক-কর্মী না ফেরার দেশে চলে গেছেন, অনেকে বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। অনেককে দলের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, কেউ তাদের ডাকেনা, খবরও নেয়না।

সময়ের সাথে সাথে তরুণ ভোটার বেড়েছে বহুগুণে। তাদের কাছে শহীদ জিয়াকে সেভাবে উপস্থাপন করা হয় না। এই তরুণ্যের ভোট অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। ‘এ অঞ্চল বিএনপির ঘাঁটি’ এমন অহংকার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। মাঠ পর্যায়ের বর্তমান চিত্র তাই বলছে।

রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় ৩৯ সংসদীয় আসন। যার ভোটার সংখ্যা এখন এক কোটি ষাট লাখের উপরে। নারী-পুরুষ ভোটার প্রায় সমান সমান। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ২০০৬ সাল পর্যন্ত সবকটিতে বারবার জয়ী হয়েছে এই পক্ষের দল।
বিগত দিনগুলোয় যখন সুযোগ পেয়েছে, তখনই ব্যালটবাক্স ভরে দিয়েছে। আরেকটি বড় দল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ অপকর্ম করে লাপাত্তা। এখানে এখন আরেক বিরোধী দল হিসাবে জামায়াত তারা দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী মাঠ চষে ফিরছে। একক প্রার্থী দিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে।

প্রার্থী না দিলেও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রত্যেকটি আসনে চার-পাঁচজন করে দলের ৩১ দফা বাস্তবায়ন নিয়ে মাঠ চষে ফিরছেন। ভোটাররা তাকিয়ে আছে বিএনপির প্রার্থীর দিকে সবাই চান যোগ্য ও ক্লিন ইমেজের মানুষ। জামায়াত বিএনপির বিরুদ্ধে সমানে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

রাজশাহীর ছয়টি আসনের সবকটি একসময় বিএনপির ঘরেছিল। এবার এ ঘরে হানা দিয়ে জামায়াত অন্তত তিনটি আসন নেবার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। বিশেষ করে রাজশাহী-১ আসন তাদের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীরের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন রাজশাহী সদর আসন-২ (সিটি কর্পোরেশন এলাকা) যা এলাকার পুরো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি তারা নিতে তৎপর। রাকসু নির্বাচনে তাদের বিশাল বিজয়ে উজ্জীবিত। সংশ্লিষ্ট আসন-৩ তাদের আরেক টার্গেট। নগরীতে তারা ঘন ঘন বড় বড় শোডাউন দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এই মুহূর্তে রাজশাহী-১ আসনটি তাদের অনুকূলে থাকলেও বাকিগুলো বিএনপির প্রার্থীর উপর নির্ভর করছে।

বগুড়া ব্যুরো প্রধান মহসীন আলী রাজু জানান, শহীদ জিয়ার জন্মভূমি বগুড়ার সাতটি সংসদীয় আসনের সাতটিতেই বিএনপি জয়ী হবে। জয়পুরহাট জেলার দুইটি আসনের দুটিতেই জিতবে বিএনপি। এই দুই জেলায় জামায়াতের ভোট বাড়বে, তবে আওয়ামী লীগের ভোট জামায়াতে যোগ হলেও স্পষ্ট ব্যবধানে জিতবে বিএনপি।

সিরাজগঞ্জের শামীম সিরাজী জানান, সিরাজগঞ্জের ছয়টি আসনের মধ্যে চারটিতে বিএনপি আর দুটিতে জামায়াত পাবে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ-১ আসনটি (বারবর, ক্যাপ্টেন মনসুর) আওয়ামী লীগের ছিল। বাপদাদার আসন তার বংশধররা ধরে রেখেছিল তারা লাপাত্তা। এখানকার আওয়ামী লীগের ভোটের উপর ভর করে জামায়াত আসনটি পেতে পারে। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনটিতে জামায়াত যেতে পারে, তবে এখানে তাদের নির্ভর করতে হবে আওয়ামী লীগের ভোটের উপর। বাকী চারটি আসনে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হবে। তবে এখানকার দলীয় কোন্দল নিরসন প্রয়োজন এবং ক্লিন ইমেজের প্রার্থী দরকার।

নাটোরের আজিজুল হক টুক জানান, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বর্তমানে নাটোরের চারটি আসনের মধ্যে দুইটিতে বিএনপি এবং দুইটিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান শক্তিশালী হিসেবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নাটোর-১ (লালপুর ও বাগাতিপাড়া) আসন বরাবরের মতো এখনো বিএনপি অধ্যুষিত। নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা (নাটোর-২) আসনটিও বিএনপির অবস্থান শক্ত। নাটোর-৩ (চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া) আওয়ামী দাপটের এলাকা এখানে তাদের সহায়তায় জামায়াত স্বপ্ন দেখছে। নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম) এখানে বিএনপির সাংগঠনিক তৎপরতার অভাবে জামায়াত জেঁকে বসেছে। নাটোরের সবকিছুই নির্ভর করছে প্রার্থীতা ঘোষণার পর।

নওগাঁর এমদাদুল হক সুমন জানান, নওগাঁয় মোট সংসদীয় আসন ছয়টি। ছয়টিতেই বিএনপির জয়লাভের সম্ভাবনা। তবে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের ভোট টানতে পারলে দুটিতে জামায়াত জয়ের সম্ভাবনা দেখা যায়।

পাবনার ইমরান রনি শেখ জানান, পাবনা-১ আসনটি জামায়াতের মরহুম মতিউর রহমান নিজামির আসন। এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী জয়ের সম্ভাবনা বেশি। পাবনা-২ বিএনপির প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা বেশি। পাবনা-৩ বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এখানে চলমান গ্রুপিং নিরসন প্রয়োজন। পাবনা-৪ বিএনপির সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এখানেও গ্রুপিং নিরসন দরকার। পাবনা-৫ বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা বেশি। পাঁচ আসনের মধ্যে চারটি বিএনপির ঘরে যাবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুসা মিয়া জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজনীতি মূলত বিএনপি ও জামায়াতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। জেলার তিনটি আসনেই দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি জনমানুষের কাছে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় সাংগঠনিক বিভেদ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সেই জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। এই সুযোগে জামায়াতে ইসলামী একক প্রার্থী মনোনীত করে মাঠে নেমেছে সক্রিয়ভাবে। অন্যদিকে ভোটারদের মধ্যেও নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এমন অবস্থায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) বিএনপি বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট)—এখানে জামায়াত বেশ শক্তিশালী। আর সদর আসন-৩-এ বিএনপি-জামায়াত অবস্থান কাছাকাছি। বিএনপির সবকিছুই নির্ভর করছে তরুণনির্ভর ক্লিন ইমেজের প্রার্থী নির্বাচনের ওপর। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ৩৯টি আসনের মধ্যে এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপির ঘরে যাবে ২৯টি আসন, আর জামায়াতের ১০টি আসন।