
সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দুই ইস্যু জুলাই জাতীয় সনদে ঐকমত্য ও অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর মাঝেই নতুন ইস্যু যোগ হয়েছে সরকারে দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। রাখঢাক নয় অনেকটা খোলামেলাভাবেই বিতর্ক ও আক্রমণের তির ছোড়া হচ্ছে উপদেষ্টাদের দিকে। আলোচিত কয়েকটি দলের নেতাদের ধনুক থেকে ওইসব তির ছোড়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কার সঙ্গে কোন দলের যোগসূত্র সেটা প্রকাশ করা হয়নি। তবে নাম প্রকাশ করার হুমকি দেওয়া হয়েছে একাধিকবার। শুধু তাই নয় সরকারে থেকে উপদেষ্টাদের করা অনিয়ম ও দুর্নীতির কল রেকর্ড রয়েছে বলেও কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
রাজনৈতিক অঙ্গন আপাতত এ ইস্যু নিয়ে সরগরম। তবে যাদের নিয়ে এত আলোচনা তাদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। দু-একজন উপদেষ্টা বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আর বেশির ভাগই চুপ রয়েছেন। রান্নাঘরে কে রে আমি তো কলা খাইনি এই প্রবাদবাক্যকে অনেক উপদেষ্টা এখন আইডল হিসেবে বেছে নিয়েছেন বলে রাজনৈতিক নেতাদের মন্তব্য। এর ব্যাখ্যায় তারা বলেন অভিযোগের জবাব স্বতঃপ্রণোদিতভাবে দিতে গেলে বিতর্কের তির নিজেদের দিকে আসতে পারে তাই উপদেষ্টারা এ নিয়ে মন্তব্য করতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ইস্যুর জবাব দেওয়া হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছেন বলে দাবি রাজনীতিবিদদের।
নির্বাচনি আলোচনা ও জুলাই জাতীয় সনদ ইস্যুর মাঝে হঠাৎ উপদেষ্টাদের নিয়ে কেন এই বিতর্ক সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। তাদের মতে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদিনই এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বর কথা বলছেন। কিন্তু কে বা কারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত সেটা খোলাসা করছে না কোনো দলই। এতে বোঝা যাচ্ছে দলগুলোর মধ্যে দিনদিন দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে সন্দেহ, সংশয় ও বিভেদ দেখা দিয়েছে। আর এসবই হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে পেতে যাওয়া ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। বড় একটি দলের অভিযোগ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এর সঙ্গে জড়িত সরকারে থাকা উপদেষ্টামণ্ডলীর কয়েক সদস্য। নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে যে কোনো মূল্যে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে চান তারা।
এ জন্য ইস্যু হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারকে। নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে তাদের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে মুদ্রার অপর পিঠে থাকা কয়েকটি রাজনৈতিক দল জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট ধরে রাখতে শুধু নির্বাচন নয় সংস্কার প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন। এসব ইস্যু নিয়ে এখন দলগুলো পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রাখছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের ওইসব বক্তব্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন।
সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। এমনকি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ হাজির করেছে জামায়াতে ইসলামী এবং তারা সরকারের কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছে। সেফ এক্সিটের প্রশ্নও উঠেছে- এই প্রশ্ন তুলেছে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। এই তিনটি দলেরই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দলগুলোও শুরু থেকে সরকারকে সহযোগিতা করার কথা বলে আসছে। কিন্তু তারাই এখন সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ তুলেছে। সে কারণে তাদের অভিযোগ ও এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে এত বেশি আলোচনা হচ্ছে। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহামদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি, কারা কোন দলের সঙ্গে যুক্ত, বা প্রশাসনের ভাগবাঁটোয়ারায় জড়িত। আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং শুনতে পাচ্ছি যে, প্রশাসনের বিভিন্ন ভাগবাঁটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচয় দেয় তারা প্রশাসন, এসপি, ডিসি ভাগবাঁটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা তালিকা করছে এবং সেগুলো সরকারকে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভিতর থেকেও সেই দলগুলোকে সহায়তা করা হচ্ছে। এভাবে চললে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রায় একই সুরে এর আগে উপদেষ্টাদের দিকে তির ছুড়েছে বিএনপি, জামায়াত ও কয়েকটি বাম দলের নেতারা।
নির্বাচনের আগে হঠাৎ উপদেষ্টাদের নিয়ে এ ধরনের বিতর্কের কারণ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়েক উপদেষ্টা বিতর্কিত কাজ করেছেন বলেই আজ তাদের নিয়ে কথা হচ্ছে। তাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে কিন্তু জবাব মেলেনি। তাই বিতর্ক বাড়ছে। আমি মনে করি উপদেষ্টাদের কারণে সরকার বিতর্কিত হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই তাদের অবিলম্বে সরিয়ে সরকারের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টাকে সামনে রেখে এখন জাতীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে। শুরুতে এটা হলে আরও ভালো বলে মন্তব্য করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। একই প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি বিভিন্ন সময় উপদেষ্টাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাই তাদের অভিযোগ যে একেবারে ভিত্তিহীন সেটা বলা যাবে না। আবার কোনো ক্ষেত্রে পাল্টাপাল্টি হিসেবে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। এসব বিতর্কের কারণে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সরকার দলনিরপেক্ষ না হলে আগামী নির্বাচন হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। বহুমাত্রিক সংকট দেখা দিতে পারে।