
ঢাকায় পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প মনোনীত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন সিনেট শুনানিতে বাংলাদেশ বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। সেখানে তিনি এ দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং আগামী বছরের শুরুতে প্রত্যাশিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসছে তার সঙ্গে কাজ করতে উন্মুখ হয়ে আছেন বলে জানান।
বিস্তৃত শুনানিতে প্রদত্ত লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন- যদি আমাকে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন দেয়া হয় তাহলে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছি তা বাস্তবায়নে একনিষ্ঠভাবে কাজ করবো। শুনানিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন বলেন- বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ। দেশটি তার বৃহৎ প্রতিবেশীদের ছায়ায় পড়ে আছে। এ কারণে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য আন্তর্জাতিক মনোযোগ সব সময় পাচ্ছে না। এ সময় তিনি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়েও কথা বলেন।
পেশাদার কূটনীতিক ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন বলেন- ’২৪ এর আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংঘটিত বিক্ষোভ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারের পতন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতিতে রয়েছে। নির্বাচনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন- বিশেষত: এটি কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হতে চলেছে। এর মধ্য দিয়ে গঠিত হবে নতুন একটি সরকার। বাংলাদেশবাসী একটি নতুন পথ বেছে নেবে। একটি উজ্জ্বল এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশের ওই যাত্রাকে পুরোপুরি সমর্থন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেন- যদি আমার নিয়োগ নিশ্চিত হয়, তাহলে আমি ঢাকাস্থ দূতাবাস টিমকে নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার তথা বিদ্যমান সরকারের উত্তরসূরির সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলবো। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেনের বক্তব্যটি প্রচারিত হয়েছে। মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে প্রদত্ত বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় টেনেছেন। সেখানে তিনি বলেন- সিনেট কমিটির সামনে উপস্থিত হতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন এজন্য আমি সম্মানিতবোধ করছি। আমার প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও’র আস্থা ও বিশ্বাসের জন্য তাদের উভয়কে ধন্যবাদ জানাই। চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে আমি এমনভাবে কাজ করতে চাই যাতে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সমুন্নতই নয়, এটি যেন দিনে দিনে আরও অগ্রসর হয়। শুনানিতে তিনি তার সহধর্মিণীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বলেন- আমার স্ত্রী ডিয়ান এখানে উপস্থিত আছেন। গত দুই দশক ধরে তিনি আমার সঙ্গী। আমার কূটনৈতিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তার ত্যাগ ও সমর্থন রয়েছে। ২০ বছরের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে বাংলাদেশে মার্কিন নীতি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন- এর মধ্যে ঢাকায় আমার কর্মকালও অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেন- আমি ভালোভাবেই জানি, বাংলাদেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কতটা তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান একে উন্মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অপরিহার্য অংশে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ সেন্টারপয়েন্ট বা সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশকে এশিয়ার ‘নতুন টাইগারদের’ অন্যতম উল্লেখ করে তিনি বলেন- দেশটি বড় বড় সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আজ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনগণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, কঠোর পরিশ্রম এবং সহনশীলতার প্রতিফলন। তিনি বলেন- আমি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক বিনিয়োগের সুযোগ সমপ্রসারণ, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা ও ঘাটতি হ্রাস, এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার জন্য কাজ করবো।
গত আট বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার অঞ্চলে বসবাস করছে, যারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছে। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় রোহিঙ্গাদের সহায়তায় অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তিনি নিজে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন জানিয়ে বলেন, সেখানকার পরিস্থিতি আমি প্রত্যক্ষ করেছি। শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রদেয় মানবিক সহায়তার বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্র বহন করছে- যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয় বলে সাফ জানান তিনি।
বলেন, অন্য দেশগুলোকে এজন্য এগিয়ে আসতে হবে। আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে, যাতে এই ভার আমাদের একার কাঁধে না থাকে। একইসঙ্গে জাতিসংঘ ও অন্যান্য অংশীদার সংস্থার সঙ্গেও কাজ করে সহায়তা কার্যক্রমের সমন্বয় জোরদার করতে হবে। তিনি বারবার বলেন, অনুমোদন পেলে, আমি বাংলাদেশের সরকার, আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বিশেষ করে সিনেট কমিটির সঙ্গে কাজ করবো যাতে একটি স্থায়ী ও কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করা যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফেরা আমার জন্য একটি বড় সম্মানের বিষয় হবে। আমি যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস, ঢাকার দক্ষ নারী-পুরুষ কর্মীদের নেতৃত্ব দিতে চাই এবং দুই দেশের অংশীদারিত্ব আরও সুদৃঢ় করতে চাই। সূচনা বক্তব্যের পর তিনি প্রশ্নোত্তর সেশনে অংশ নেন।