
পরিবহন খাতের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা আর জনভোগান্তির কেন্দ্রে থাকা সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এখন আধুনিকায়নের পথে হাঁটছে। লাইসেন্সবিহীন চালক, ফিটনেসবিহীন লক্করঝক্কর বাস আর ঘুষের চক্র— এমন নানা অভিযোগের বেড়াজাল পেরিয়ে বিআরটিএ-কে ঢেলে সাজানোর বার্তা দিলেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতার কথা। তবে একইসঙ্গে তিনি জানালেন, দক্ষ চালক তৈরি, ডিজিটাল সেবা চালু এবং সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে সময়সীমা বৃদ্ধির মতো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। চেয়ারম্যানের অকপট স্বীকারোক্তি এবং আধুনিকায়নের এই অঙ্গীকার, দেশের সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কতটা সফল হবে, সেই আলোচনা তুলে ধরেছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক হাসনাত নাঈম।
ঢাকা পোস্ট : ঘুষ ছাড়া বাসের ফিটনেস হয় না। ন্যূনতম তিন হাজার টাকা লাগে বলে বাস-মালিকদের অভিযোগ। এটির সঙ্গে আপনার কর্মকর্তারা ও দালালরা জড়িত। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : তিন হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারে আমি অবগত নই। যদি কেউ এমন করে থাকে এবং প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বিষয়টিকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজ করার উদ্যোগ নিচ্ছি। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (RFID) স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।

ঢাকা পোস্ট : ঢাকায় লক্করঝক্কর বাসের সংখ্যা অনেক। কেন এমন পরিস্থিতি?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : ঢাকায় পাঁচ লাখ বাস রেজিস্ট্রেশন দেওয়া থাকলে, বাস্তবে এর দ্বিগুণ বাস সড়কে চলছে। আমাদের সড়কের তুলনায় বাসের সংখ্যা বেশি, আবার যাত্রীদের চাহিদাও অনেক। ফলে বাস রিপ্লেসমেন্ট না করে এগুলো সড়ক থেকে সরানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে, ডাম্পিং করে রাখার জায়গাও নেই। আমরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। উত্তরা ও আগারগাঁওয়ে আমাদের দুটি ডাম্পিং স্টেশন আছে। গত মাসেই ৩৬৪টি গাড়ি ডাম্পিং করা হয়েছে।
উন্নত দেশ, যেমন— জাপানে সাত বছর পর বাস সড়ক থেকে সরানো হয়, অথচ সেগুলোর অবস্থা আমাদের দেশের নতুন বাসের মতো ভালো থাকে। কম মূল্যে সেসব বাস আমদানির সম্ভাবনা বিবেচনা করছি। পাশাপাশি বাস-মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার বিষয়েও কাজ চলছে। যাতে তারা নতুন বাস এনে পুরনোগুলো রিপ্লেস করতে পারেন।
ঢাকা পোস্ট : সড়কে অনেক চালক ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালান। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : আমাদের দেশের বেশিরভাগ চালকই ‘ওস্তাদের হাত ধরে’ ড্রাইভিং শিখেছেন। তারা গাড়ি চালাতে পারলেও যথাযথ তাত্ত্বিক ও ট্রাফিক জ্ঞান না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে। যদিও বর্তমানে বাজারে প্রায় ৭৩ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : চালকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে আপনারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : দক্ষ চালক গড়ার জন্য আমরা অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। এখন আর শুধু সাধারণ শিক্ষা সনদ থাকলেই কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। তাকে অবশ্যই ড্রাইভিং স্কুল থেকে ৬০ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এখন পর্যন্ত সারাদেশে ১৪৮টি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল নিবন্ধন করা হয়েছে। পাশাপাশি আমরা ৫০ জন প্রশিক্ষক তৈরি করছি, যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বিদেশি বিশেষজ্ঞরা। এই প্রশিক্ষকেরা পরে দেশব্যাপী অন্যান্য প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।

ঢাকা পোস্ট : ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের দেওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড তিন বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : এর আগে যারা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তারা কাজটি সঠিকভাবে করেনি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঁচ লাখের মতো কার্ড তারা দেয়নি। তাই তাদের নবায়নের আবেদন, আসলে আমরা তাদের বাতিল করেছি। এখন নিজেরাই কীভাবে এটি আমরা করতে পারি, তা নিয়ে কাজ চলছে। আমরা সেবাগ্রহীতাদের মানসম্মত সেবা দিতে চাই। কাজটি হবে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে।
ঢাকা পোস্ট : সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে বিআরটিএ কী ভূমিকা রাখছে?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। আমরা দক্ষ চালক তৈরি করছি, নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছি এবং আইন প্রয়োগ করছি। একইসঙ্গে চালকদেরও সচেতনতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে হবে, যেহেতু রাস্তায় গাড়ি অনেক বেশি।
ঢাকা পোস্ট : দুর্ঘটনা তহবিলের সর্বশেষ অবস্থা কী?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : এখনও দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ দুর্ঘটনা তহবিল সম্পর্কে জানেন না। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সবাইকে জানাতে, আপনারাও সহযোগিতা করুন। প্রতি বছর এই তহবিলে প্রায় ১১০ কোটি টাকা জমা হয়। আমি যখন বিআরটিএতে যোগ দিই, তখন তহবিলে ৩০৭ কোটি টাকা জমা ছিল। এর মধ্যে গত তিন মাসে আমরা প্রায় ২৪ কোটি টাকা বিতরণ করেছি। আগামী সপ্তাহে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে আরও ১৫০টি চেক বিতরণে যাচ্ছি।
বর্তমানে দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয়। কিন্তু আমরা এটি ৬০ দিনে উন্নীত করার চেষ্টা করছি, কারণ অনেক পরিবার শোক কাটিয়ে উঠে আবেদনের সময় পায় না। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর্থিক সহায়তার ১,৮১১টি চেক বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নিহত ১৫২৭ জন, আহত ২১২ জন ও গুরুতর আহত ৭২ জন। সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে ৮০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

ভবিষ্যতে বিআরটিএ’র সার্ভিস পোর্টালের মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ডের এই সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। এটি সাধারণ মানুষের হক, আমার দায়িত্ব এটি পৌঁছে দেওয়া। আমি আমার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি— দুর্ঘটনার খবর পেলেই তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ করতে।
ঢাকা পোস্ট : নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে। পুরনো বাস-রুটগুলো কি পরিবর্তন বা সম্প্রসারণ হবে?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : এই বিষয়ে মন্তব্য করা আমার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) এবং বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটিই বিষয়টি দেখবে। তবে যেহেতু নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তাই রুট পরিবর্তন বা সম্প্রসারণ হতে পারে।
ঢাকা পোস্ট : বিআরটিএ-কে আধুনিকায়ন করতে আপনারা কী কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : ডিজিটাল সেবার বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বিআরটিএ। এটির পোর্টালের মাধ্যমে নাগরিকরা অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন নবায়নসহ বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করছেন। আবেদন, ফি প্রদান এবং অনুমোদনের পর ই-লাইসেন্স ও ই-রেজিস্ট্রেশন সরাসরি ডাকযোগে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। মালিকানা পরিবর্তনে কম্পিউটারাইজড রশিদ, ডিজিটাল আর্কাইভিং ও আঙুলের ছাপ যাচাই, আর ফিটনেস নবায়নে আরএফআইডি রিডার ব্যবহারের মাধ্যমে শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে। অনলাইনে ট্যাক্স টোকেন নবায়ন, বিকাশ পেমেন্ট এবং ই-ট্যাক্স টোকেন ডাউনলোডের সুবিধাও চালু রয়েছে।

এছাড়া, বিআরটিএ রুট পারমিট সনদ ইস্যু ও নবায়ন অনলাইনে পরিচালনা করছে। সংস্থাটি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে ৮০ কোটি ৬৩ লাখ টাকার সহায়তা দিয়েছে। দেশজুড়ে ১৪৮টি মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল ও ১,৩৭৭ জন ইন্সট্রাক্টরকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, মোটরযান মেরামত কারখানা ও বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের অনুমোদন ধীরে ধীরে অনলাইনে রূপান্তর করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ও মোটরযানের এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেটও অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ : ঢাকা পোস্টের জন্য শুভকামনা।