Image description

রাজধানীর মগবাজার মোড় আর ইস্কাটনের মাঝপথে থাকা ‘অ্যাট দ্য টেবিল’ এখন ঢাকাবাসী অনেকের জন্যই নিয়মিত আড্ডার জায়গা। এই ফুড কোর্টটি যে জায়গায় অবস্থিত, তা বোধহয় এ শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত রাস্তাগুলোর একটি। ওই রেস্টুরেন্টটির মালিক পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুব হোসেনের স্ত্রী তাসলিমা বেগম কুইন।

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব হোসেন শুধু নিজের নামেই নন, বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনের নামেও। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী দেখিয়ে স্ত্রীর নামেও গড়েছেন অঢেল সম্পদ। মাহবুব দম্পতির করবর্ষের একটি ফাইল থেকে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য।

মগবাজার মোড়ের ‘অ্যাট দ্য টেবিল ফুড কোর্টে’ ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক তাসলিমা। তা তিনি কিনেছেন মাত্র ১৫ লাখ টাকায়। আর বাকি শেয়ারের মালিক সালমা বেগম নামে আরেক নারী। জানা যায়, গৃহিণী তাসলিমা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছেন গত এক বছর ধরে। চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি মাহবুব হোসেন এবং তাসলিমা বেগম কুইনের সঙ্গে। তবে তাদের রেস্টুরেন্ট দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাদশা নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, তাদের কারও ফোন নম্বর আমার কাছে নাই। স্যার দেশে নাই, আর ম্যাডাম ঢাকার বাইরে। আমি এক বছর ধরে চালু হওয়া রেস্টুরেন্ট দেখাশুনায় আছি।

বিসিএস অষ্টম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব হোসেনের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরে। তিনি ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে অবসরের পর পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। জানা যায়, ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট’ নামক একটি সংকলন সম্পাদনার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে ক্রাইম রিসার্চ ইনডেক্স (সিআরআই)-এর সঙ্গে যুক্ত হন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে দুই ছেলের কাছে চলে যান।

সূত্র জানায়, তাসলিমা বেগম কুইনের সাউথ-ইস্ট ব্যাংকের ইস্কাটন শাখা এবং সোনালী ব্যাংকের মগবাজার শাখায় ডিপিএসের জমা রয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সে পলিসি বাবদ জমা রয়েছে ৬১ হাজার ৯৩০ টাকা। মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্সে পলিসি বাবদ জমা করা হয় ৬০ হাজার টাকা। হাতে তার নগদ রয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকে জমা আছে ৩২ হাজার ৬১ টাকা, ডাচ-বাংলা ব্যাংকে জমা ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৪১ টাকা এবং এক্সিম ব্যাংকে জমা ৪৭ হাজার ৯০৩ টাকা। ব্যবসায় তিনি পুঁজি দেখিয়েছেন ৭ লাখ ৬২ হাজার টাকা। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ দেখিয়েছেন ২৬ লাখ ৭২ হাজার ৪৫০ টাকা। এর মধ্যে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স হিসেবে প্রাপ্তি দেখিয়েছেন ১৮ লাখ টাকা। আর সঞ্চয়পত্র কিনেছেন ১০ লাখ টাকার। ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দামের হাতিরঝিলে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট এবং সঙ্গে ১২০ বর্গফুটের কারপার্কিং রয়েছে। মগবাজারের নাজির হাজের হাইটসের ১ হাজার ৯০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট এবং সঙ্গে একটি কার পার্কিং। এর দাম দেখিয়েছেন মাত্র ৪৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কিশোরগঞ্জের ভৈরবে রয়েছে ৩৭ দশমিক ৬৭ শতক জমি। রাজধানীর খিলক্ষেত ডুমনিতে ৫ শতাংশ জমি কিনেছেন। এই জমির মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। এই টাকার উৎস বিভিন্ন সম্মানি থেকে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং বাকি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। রাজধানীর ইস্কাটনে মাহমুদিয়া মঞ্জিলে ১ হাজার ৪৪৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে এবং সঙ্গে কারপার্কিং রয়েছে। মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৪২ লাখ ৬৫ হাজার ৮০০ টাকা। এই টাকারও উৎস দেখিয়েছেন বৈদেশিক রেমিট্যান্স।

তবে অবৈধ সম্পদ এবং অর্থ পাচার নিয়ে অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন দুদক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেসব সরকারি কর্মকর্তা কিংবা রাজনীতিবিদ অবৈধ উপায়ে সম্পদ গড়েছেন। তারা হুন্ডির মাধ্যমে সেসব টাকা বিদেশে পাঠায় এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে তা রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে এনে বৈধ করার চেষ্টা করে।

সূত্র জানায়, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুব হোসেন তার করবর্ষের ফাইলে হাতে নগদ দেখিয়েছেন ২৮ লাখ ৭২ হাজার ১৫৬ টাকা। ৯ লাখ টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন। সোনালী ব্যাংকের মুন্সিগঞ্জ শাখায় তার জমা আছে ৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫৫ টাকা। এই টাকা তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাবাবদ সরকার থেকে পেয়েছেন। আর পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমিতিতে তার জমা রয়েছে ৫০ হাজার টাকা। পুলিশ কমিউনিটি ব্যাংকে বিনিয়োগ আছে ২৭ হাজার টাকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা দুই পুত্র জাওয়াদ তাজোয়ার মাহবুব এবং সাকিব তাজোয়ার মাহবুবের নামে ৬০ লাখ করে মোট ১ কোটি ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দিয়েছেন। মেসার্স মাজা লিমিটেডে তার ৭৪ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে। মিডওয়ে সিকিউরিটিজে শেয়ার রয়েছে ২ লাখ ৯ হাজার ১৪৩ টাকার। সঞ্চয়পত্র রয়েছে ৫০ লাখ টাকার। প্রাইজবন্ড রয়েছে ৫০ হাজার টাকার। স্বর্ণালংকার রয়েছে ৬ লাখ টাকার। সরকার থেকে পাওয়া মিরপুরে জাতীয় গৃহায়নে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, ফ্ল্যাটটির মূল্য দেখিয়েছেন ৫৬ লাখ টাকা। নারায়ণগঞ্জ জলসিঁড়িতে ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩৬ টাকার ৫ কাঠার প্লট রয়েছে। পূর্বাচলে ২ নম্বর সেক্টরে ১০ কাঠার আরেকটি প্লট রয়েছে, এর মূল্য ২১ লাখ ৩০ হাজার ২৬৪ টাকা। এই টাকার উৎস হিসেবে দেখিয়েছেন বেতন-ভাতা এবং বৈদেশিক মুদ্রা থেকে অর্জিত। খিলক্ষেতের পুলিশ অফিসার বহুমুখী সমবায় সমিতিতে ৬ দশমিক ৯ কাঠার আরেকটি প্লট রয়েছে। এর মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ২৩ লাখ টাকা। এই টাকার উৎসও দেখিয়েছেন বেতন-ভাতা এবং বৈদেশিক মুদ্রা থেকে অর্জিত। সাভার পুলিশ প্লাজায় ১ হাজার ৬৫০ বর্গফুটের আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এই টাকারও উৎস বেতন-ভাতা এবং বৈদেশিক মুদ্রা।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৩০ জুলাই মাহবুব হোসেন এবং তার স্ত্রী তাসলিমা বেগম কুইনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।