Image description
পুলিশ যখন মাফিয়া

হারুন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে। তাকে বলা হতো আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন করাই ছিল তার একমাত্র কাজ। এটি করে যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়েছিল হারুন। পুলিশে চাকরিজীবনের শুরু থেকেই সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন ছিলেন বেপরোয়া। কখনোই চাকরিবিধির তোয়াক্কা করেননি। যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই নানান অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। চাকরির প্রতিটি ধাপে প্রতারণা ও উচ্ছৃঙ্খল কর্মকান্ডে জড়িত থাকলেও তাকে কখনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। উল্টো পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব ইউনিটে। তিনি যে এলাকাতেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই জড়িয়েছেন অপকর্মে।

২০১১ সালের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের সামনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত হন ডিএমপির তেজগাঁও জোনের তৎকালীন ডিসি (অতিরিক্ত উপকমিশনার) হারুন অর রশীদ। এ ঘটনার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থা কুড়ান আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা। ২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট তিনি গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পান। এর মাত্র চার মাস পর ২৬ ডিসেম্বর গাজীপুরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জনসভায় ১৪৪ ধারা জারি এবং নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও দমনপীড়নের মাধ্যমে ওই জনসভা ভন্ডুল করে দেন এসপি হারুন। এ ঘটনায় নতুন করে আবারও আলোচিত হন হারুন। টানা চার বছর গাজীপুরে পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে ছিল অভিযোগের পাহাড়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল এসপি হারুন অর রশীদকে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর দোর্দ- প্রতাপশালী এই পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যাহারের আদেশ তুলে নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাত্র ১১ দিনের ব্যবধানে। ৩ মে গাজীপুরের এসপি পদে পুনর্বহাল হন তিনি। এরপর ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর শুরু হয় এসপি হারুনের নারায়ণগঞ্জ অধ্যায়।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নারায়ণগঞ্জে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন ও দমনপীড়নের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন হারুন। অপহরণ, গুম, চাঁদাবাজির মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন জেলার দন্ডমুন্ডের কর্তা। সে সময় শামীম ওসমানের সঙ্গে দ্বন্দ্বসহ নানান বিতর্কিত কর্মকান্ডে আলোচিত হন এই পুলিশ কর্মকর্তা। চাঁদার জন্য তিনি একাধিক শিল্পপতিকে তুলে নিয়ে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর ভয় দেখাতেন। ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর এসপি হারুনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে (ট্রেনিং রিজার্ভ) সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের আশীর্বাদে এসপি হারুনকে ২০২০ সালের ৯ জুন ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) হিসেবে তেজগাঁও বিভাগের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এরপর ২০২১ সালের ২ মে তাকে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি দিয়ে ১১ মে ডিএমপির যুগ্মকমিশনার করা হয়। এরপর ২০২২ সালের ১২ জুন হারুনকে ডিএমপির ডিবিপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ডিবিপ্রধান হিসেবে বিএনপির নয়াপল্টন অফিসে নানান নাটক মঞ্চস্থ করে নেতা-কর্মীদের গণগ্রেপ্তার ও দমনপীড়নে নেতৃত্ব দেন হারুন। হেফাজতে ইসলামের অনেক নেতা তার দ্বারা নিগ্রহের শিকার হন। ডিবি অফিসে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজ এবং সেসবের ছবি সমাজমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে তিনি ডিবিপ্রধানের কার্যালয়কে পরিচিত করান ভাতের হোটেল হিসেবে। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে নিরাপত্তা হেফাজতের নামে আটকে রেখে ভিডিও স্টেটমেন্ট নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচিত ও সমালোচিত হন। এরপর ২০২৪-এর ৩১ জুলাই তাকে ডিবি থেকে সরিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) দায়িত্ব দেওয়া হয়। গাজীপুর জেলায় দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ ওঠে। ক্ষমতার দাপটে কোণঠাসা ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এমনকি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও। টাকার জন্য তার জিম্মি ফাঁদে পড়েন খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও। গাজীপুর থেকে বদলি হওয়ার পর হারুনের নানান অপকর্মের বিষয় আলোচনায় আসে।

শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, বিরোধী মত দমনেও হারুন ছিলেন সীমাহীন বর্বর।

২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর বেলা ১টা। গাজীপুর পৌর সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলার মুক্তসংবাদ পত্রিকা অফিস থেকে ডিবি পুলিশের সদস্যরা জোরপূর্বক টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যান পত্রিকাটির সম্পাদক-প্রকাশক মো. সোহরাব হোসেনকে। তিনি ছোটবেলা থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী। যারা তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তাঁকে নেওয়া হচ্ছে? ডিবির সদস্যরা জবাব দেন এসপি হারুনের নির্দেশে তাঁকে নেওয়া হচ্ছে।

সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, ‘আমাকে প্রথমে নেওয়া হয় গাজীপুর ডিবি অফিসে। সেখানে গিয়ে দেখি সাব-রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম বসে আছেন। যার বিরুদ্ধে ঘটনার কয়েক দিন আগে বিভিন্ন দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে আমার পত্রিকায় তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট করেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তৎকালীন ডিবির ইন্সপেক্টর আমির হোসেন আমাকে বলেন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে আমি চাঁদা চেয়েছি। কিন্তু কখনোই আমি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যাইনি। ওই অফিসের আটটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই সেটি নিশ্চিত হওয়া যেত। কিন্তু তারা আমার কথা শোনেননি। বরং আমাকে বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে কোর্টে নিয়ে গারদখানায় আটকে রাখতে চেয়েছিলেন। পরে সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখে চাঁদাবাজির মামলা তৈরি করে আমাকে আদালতে তোলা হয়। ওই মামলায় আমি ১৭ দিন জেলে ছিলাম। ওই দিনই আবার জেলগেট থেকে তুলে নিয়ে এসপি হারুনের কাছে আমাকে মুচলেকা দিতে হয়েছে।’

শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, ভিন্নমত দমনে হারুন চালাতেন মানসিক নিপীড়ন। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে এসে করা হতো ব্ল্যাকমেল। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে হারুন ডিবি অফিসে নিয়ে আসেন। এরপর হারুনের ভাতের হোটেলে তাঁকে খেতে দিয়ে সেই ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এটি ছিল নোংরা ও কুৎসিত চরিত্রহননের চেষ্টা। তবে হারুনের সবচেয়ে জঘন্য কাজ ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়। তিনি ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বেআইনিভাবে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে এসে মুচলেকা দিতে বাধ্য করেছিলেন। আন্দোলন দমাতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেন। ছাত্রদের ভাত খেতে দিয়ে সেই ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক নিপীড়ন, বিরোধী দলের চরিত্রহননের মতো নোংরা আইনবহির্ভূত কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন হারুন।