
কোলে পিঠে কইরা ২৫টা বছর বড় করছি আমার জুবুরে। কত স্বপ্ন ছিল আমার জুবুকে নিয়ে। কত স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা পাঠাইছিলাম পড়তে। কত স্বাদের পোলা আমার আজ আমার জুবুর মরা দেহ নিতে ঢাকা আইছি। আমার জুবু আমারে আর বাপ কইয়া ডাকব না। আমার জুবু আর আইব না। আমার জুবু কই? এভাবেই ছেলের জন্য আর্তনাদ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জুবায়েদ হোসাইনের বাবা মো. মোবারক হোসাইন। সোমবার (২০ অক্টোবর) ভোর ৫ টায় বংশাল থানায় মামলার প্রস্তুতিকালে এসব কথা বলেন তিনি।
এর আগে রবিবার আরমানীটোলায় নূরবক্স লেনে টিউশনিতে গিয়ে ছাত্রীর বাসায় খুন হয় জুবায়েদ। এ ঘটনায় রাত ১টার দিকে মামলা দিতে আসেন জুবাইয়েদের বাবা-ভাইসহ পরিবার। এসময় মামলায় বিলম্ব হলে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমার ছেলের নাম জুবায়েদ হোসাইন। আমি ভালোবেসে আদর করে ডাকতাম জুবু।
জুবু বাড়িতে গেলে আমার ব্যবসায়ীক লোকজন বলে দেখ ঢাকা থেকে তোমার জুবু এসেছে। আমার জুবু আর আমার কাছে যাবে না।আমারে আর বাপ কইয়া ডাকব না। আমার চার ছেলের মধ্যে জুবু মেজো। খুবই ভদ্র ও মেধাবী ছিল। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিল। ওর স্বপ্ন ছিল বড় অফিসার হওয়া। স্বপ্ন আজ কবরে চলে গেল।
আমার জুবু ছিল তাগড়া জোয়ান। ওর স্টাইল আর চুল আমার খুব পছন্দ। ও বাড়িতে গেলে আমি মাথার চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতাম। পোশাক পরিচ্ছদে আমার ছেলে খুব স্মার্ট ছিল। আমি কখনো অভাব বুঝতে দেয়নি। গত সপ্তাহে বাড়িতে গিয়ে ওর মাকে বলে মোবাইল কিনবে। আমি ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি। ওর কাছে ৫ হাজার টাকা ছিল ওইটা দিয়ে ২০ হাজার টাকার একটা মোবাইল কিনেছে। ওর মাকে আমি কি বুঝ দিব? ওর মা পাগল হয়ে যাবে। ওর বাড়ি যাবার সময় হলে ওর মা নানাকিছু রান্না করত। ওর পছন্দের খাবার জমিয়ে রাখত। গত সপ্তাহে বাড়িতে গেছিল। আবার আগামী সপ্তাহে বাড়ি যাবে বলেছিল কিন্তু আজ লাশ হয়ে হয়ে গেছে। লাশ হয়ে ফিরবে এখন। আমার কোনো ভাষা নেই বাবা।
এসময় কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ওরা (আসামিরা) আমার পোলারে একেবারে মাইরা ফেলল। ওর সাথে কোনো শত্রুতা থাকলে একটা হাত বা একটা পা ভেঙ্গে দিত। আমি চিকিৎসা করাতাম। সর্বোচ্চ ৬ মাস বাসায় বইসা থাকত। তবুও আমার পোলাডা বাইচা থাকত। আমি ওরে ঢাকায় রাখতাম না। কিন্তু ওরা আমার কলিজার ধনরে মাইরা ফেলল।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জানাযায় দাঁড়িয়ে বাবা মোবারক হোসেন সবার উদ্দ্যেশ্যে বলেন, আমি আমার ছেলেকে দিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। কিন্তু আজকে আমার ছেলে লাশ। আমি বাবা এখনও বেঁচে আছি। সকলের কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই।
আরও পড়ুন : সন্ধ্যায় রক্তাক্ত হাতে বাসায় ফেরেন মাহির রহমান
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার বয়স ৫৮ বছর। আমার জীবন যৌবনের ফসল শেষ। আমি প্রকৃত খুনির বিচার চাই। ড. ইউনুস, প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমি প্রকৃত খুনির বিচার চাই।
জানা গেছে, রবিবার জুবায়েদ হোসাইন পুরান ঢাকার আরমানীটোলায় টিউশনিতে গিয়ে খুন হয়।তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯- ২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। একই সাথে তিনি কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণের সভাপতি ও শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য ছিলেন।
গত এক বছর ধরে জুবায়েদ হোসাইন পুরান ঢাকার আরমানীটোলায় ১৫, নুরবক্স লেনে রৌশান ভিলা নামের বাসায় বর্ষা নামের এক ছাত্রীকে ফিজিক্স ক্যামেস্ট্রী ও বায়োলজি পড়াতেন। ওই ছাত্রী বর্ষার বাবার নাম গিয়াসউদ্দিন। রবিবার (১৯ অক্টোবর) আনুমানিক বিকাল ৪ টা ৪৫ মিনিটের দিকে ছাত্রীর বাসার তিন তলায় উঠতে সিড়িতে তিনি খুন হন। বাসার নিচ তলার সিঁড়ি থেকে তিন তলা পর্যন্ত সিঁড়িতে রক্ত পড়েছিল। তিন তলার সিঁড়িতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরবর্তীতে আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে বংশাল থানার সামনে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
পাশাপাশি তারা তাতীবাজার মোড় অবরোধ করে রাখে। রবিবার রাত ১১ টার দিকে ওই ছাত্রী বর্ষাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ ওই ছাত্রীকে হেফাজতে নেয়। এদিন রাত ১১ টার সময় আরমানিটোলার নূরবক্স রোড়ের নিজ বাসা থেকে তাকে পুলিশ প্রটোকলে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। এর আগে রাত ১০ টা ৫০-এর সময় খুনের শিকার জুবাইদ হোসাইনের লাশ ময়না তদন্তের জন্য মিডফোর্ড হাসপাতালে নেয় পুলিশ। আজ সোমবার তার ময়নাতদন্ত শেষ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।
২৪ ঘন্টা পেরোলেও হয়নি কোনো মামলা। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য জুবায়েদ হোসাইন খুনের ঘটনায় ওই ছাত্রী বর্ষাসহ মোট চার জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানান লালবাগ জোনের ডিসি মল্লিক আহসান উদ্দিন সামি। তিনি বলেন, বিশেষ অভিযানে আমরা এখন পর্যন্ত ওই মেয়ে ছাড়া আরও তিনজন আসামিকে আটক করেছি। তবে এখনই তাদের নাম পরিচয় আমরা প্রকাশ করবো না তদন্তের স্বার্থে। আগামীকাল সকালে আমরা বিস্তারিত বিফ্রিং করব। এ ছাড়া আপাতত আর কিছুই বলা যাবে না। নতুন আটক তিনজনই যুবক।