Image description

আমানতের হেফাজত করা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত। আমানতদারিতা হলো গচ্ছিত অর্থ বা অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে রক্ষা করা এবং পরে তা প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। ইসলামী ধারার ব্যাংকিংও গড়ে উঠেছে এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে। যদিও দেশের শরিয়াহভিত্তিক বেশির ভাগ ব্যাংক গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ‘খেয়ানত’ করেছে। এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সংগঠিত অনিয়ম-দুর্নীতিতে ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ডেরও সায় ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

ইসলামী ধারার ব্যাংকের নীতিনির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি। শরিয়াহ বোর্ড নামে পরিচিত এ কমিটির মূল দায়িত্ব হলো ইসলামী নীতির আলোকে ব্যাংক পরিচালনা নিশ্চিত করা, শরিয়াহসম্মত ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং শরিয়াহ লঙ্ঘন থেকে ব্যাংককে রক্ষা করা। এ ধারার ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্পিত দায়িত্ব পালনে শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যরা অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে বোর্ডে থাকা স্বনামধন্য ব্যক্তিরা অনিয়মের সঙ্গী হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ সভার সম্মানী বাবদ ৫ হাজার টাকা নেয়ার কথা থাকলেও ৫০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষে পরিবর্তন এলেও শরিয়াহ বোর্ড অপরিবর্তিত থেকেছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এলেও সেটি যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ইসলামী ধারার পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্ণোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। একীভূত প্রক্রিয়ায় না গেলেও লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের বৃহত্তম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিও। এ ছয়টি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘুরেফিরে ১০ জন ব্যক্তি এসব ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এ নিয়ন্ত্রণের নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদার। এখনো সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান পদে থাকা এ অধ্যাপক এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত সবক’টি ইসলামী ধারার ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। চেয়ারম্যান পদে না থাকলেও তিনি এখনো এ তিনটি ব্যাংকেরই শরিয়াহ বোর্ডে রয়েছেন।

ইসলামী ধারার বিপর্যস্ত ছয়টি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডে দায়িত্ব পালনকারী অন্য প্রভাবশালীরা হলেন ঢাকার জামিয়াতুস সিদ্দিকীয়া দারুল উলুমের (মাদ্রাসা-ই-ফুরফুরা) প্রধান মুফতি সাঈদ আহমেদ মুজাদ্দিদী, চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক (মুহতামিম) মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী, ড. মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, ঢাকার সাভারের জামিয়া ইসলামিয়া মারকাজুল উলুম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী, বেসরকারি হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের জ্যেষ্ঠ ইমাম মুফতি মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকী ও ঢাকার বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু নোমান মো. রফিক রহমান।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর বিপর্যয়ের জন্য শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। অন্যথায় আগামীতেও একই ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি সংগঠিত হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের এ দাবির সঙ্গে একমত নন শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যরা। তাদের দাবি, শরিয়াহ বোর্ডের হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যেসব তথ্য উপস্থাপন করেন, সেগুলোর ভিত্তিতে তারা কেবল ‘ফতোয়া’ দেয়ার অধিকারী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শরিয়াহ বোর্ড দুদক কিংবা কোনো তদন্ত সংস্থা নয়। এ কমিটির তেমন কোনো ক্ষমতাও নেই। কমিটির কাছে কোনো বিষয়ে ফতোয়া চাওয়া হলে কেবল সে বিষয়েই ফতোয়া দেয়া হয়। ব্যাংক কাকে বিনিয়োগ দিচ্ছে, কার কাছ থেকে আমানত নিচ্ছে, এসব বিষয়ে শরিয়াহ বোর্ডের কাছে কোনো তথ্য থাকে না। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যতটুকু তথ্য জানায়, আমরা কেবল সেটুকুই জানি। কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপন করে ফতোয়া চাইলে আমাদের কিছু করার নেই।’

যদিও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর দুর্দশার দায় শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদেরও নিতে হবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিন্সের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম কবির হাসান। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের এ বিশেষজ্ঞ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইসলামে আমানতদারিতা রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত কঠোর। আমানতের খেয়ানত কোনোভাবেই এখানে সমর্থনযোগ্য নয়। শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যরা সমাজে আলেম হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাদের ফেস ভ্যালুর গুরুত্ব আছে। শরিয়াহ বোর্ডের দায়িত্ব কেবল নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে হালাল-হারামের ফতোয়া দেয়া নয়। ব্যাংকে রক্ষিত জনগণের আমানতের জিম্মাদারিত্বও তাদের রয়েছে।’

দায়িত্ব পালনে শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যরা ব্যর্থ হয়েছেন দাবি করে অধ্যাপক এম কবির হাসান বলেন, ‘শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যরা জনগণের আমানত রক্ষা করতে পারেননি। এজন্য অবশ্যই তাদের পরকালীন শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তবে দুনিয়াতে খেয়ানতকারীদের বিচার হবে না, এটি মানা যায় না। অল্প কিছু মানুষ যুগের পর যুগ ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। নিজেদের রাজত্ব ধরে রাখতে সিন্ডিকেটের সদস্যরা আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জ্ঞান রাখা তরুণ শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের কোনো বোর্ডে ঢুকতে দেন না। ব্যাংকগুলোর দুর্দশার জন্য পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের শাস্তির পাশাপাশি শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদেরও শাস্তি হওয়া দরকার।’

শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর এখন পর্যন্ত ১৫টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছেন। এর মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) করা হয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অডিট ফার্ম দিয়ে। ‘আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং’ ও ‘কেপিএমজি’র করা এ নিরীক্ষা গত মে মাসে শেষ হয়। একিউআর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী শরিয়াহভিত্তিক এ পাঁচ ব্যাংকে জমা থাকা আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। আর ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ (বিনিয়োগ) স্থিতি ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকাই খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৭৬ দশমিক ৬৯ শতাংশই খেলাপি। এ পাঁচ ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা বলে নিরীক্ষায় উঠে আসে।

প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে খেলাপির হারে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইউনিয়ন ব্যাংকের। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৯৭ দশমিক ৮০ শতাংশ খেলাপি। আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ৩৭ ও গ্লোবাল ইসলামীর ৯৫ দশমিক ১০ শতাংশ ঋণ খেলাপিযোগ্য বলে একিউআর প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ দশমিক ২০ ও এসআইবিএলের ৬২ দশমিক ৩০ শতাংশ ঋণ খেলাপি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ব্যাংকের বাইরে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার কোটি টাকা। দেশের বৃহত্তম এ ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৪২ শতাংশ। সব মিলিয়ে শরিয়াহভিত্তিক এ ছয় ব্যাংকের মোট খেলাপিযোগ্য ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকায় ঠেকেছে।

এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হন ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদার। এরপর ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সময়ের মধ্যেই দেশের সর্ববৃহৎ এ ব্যাংকটিতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে। এস আলম নিজেই দেড় দশক ধরে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সময়ে ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন গিয়াস উদ্দীন তালুকদার। আবার গ্রুপটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন আলোচিত এ ইসলামী বক্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদারের ভাষ্য, ‘ইসলামী ব্যাংকিং অনুযায়ী মাদক, তামাকসহ শরিয়াহ নিষিদ্ধ ব্যবসায় ঋণ দেয়া যায় না। শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো কোনো আয় নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হলে সেটির বিষয়ে ফতোয়া দেয়া। ব্যাংকের বিনিয়োগ (ঋণ) ও আমানত প্রডাক্টগুলো শরিয়াহভিত্তিক হচ্ছে কিনা সেটি দেখা। ব্যাংকের জাকাত তহবিলের অর্থ যথাযথ খাতে ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখা। আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ চুরি ঠেকানোর দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের। তারা কী দায়িত্ব পালন করেছে, সেটি তাদেরই জিজ্ঞাসা করা উচিত।’

এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্য হয়ে ওঠেন চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক (মুহতামিম) মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ। ২০২৩ সালে তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ পেয়েছিলেন। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শরিয়াহ বোর্ড থেকে তাকে বাদ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। কেবল ইসলামী ব্যাংকই নয়, এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর ওবায়দুল্লাহ হামযাহ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকেরও শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবক’টি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ড থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে।

১৯৯৮ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে আছেন মুফতি সাঈদ আহমেদ মুজাদ্দিদী। ঢাকার জামিয়াতুস সিদ্দিকীয়া দারুল উলুমের (মাদ্রাসা-ই-ফুরফুরা) প্রধান মুফতি তিনি। এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরও তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন। একই সময়ে তিনি আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। চেয়ারম্যান ও সদস্য ছিলেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডেও। বর্তমানেও তিনি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

দুর্দশায় পড়া ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্যদের একজন ড. মোহাম্মদ আবদুস সামাদ। ২০১৬ সাল থেকে তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য সচিব। তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডে যোগ দেন ২০০৪ সালে। একই সঙ্গে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আভিভা ফাইন্যান্সের শরিয়াহ বোর্ডেরও সদস্য হিসেবে রয়েছেন তিনি। এ দুটি প্রতিষ্ঠানও এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকার সময়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। মোহাম্মদ আবদুস সামাদ ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের টিচার অব রিলিজিয়াস অ্যাটাশে।

২০০৭ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী। একই সময়ে তিনি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য সচিবও ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডে রয়েছেন। এছাড়া দেশের আরো কয়েকটি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের শরিয়াহ উইংয়ের উপদষ্টাও তিনি।

২০০৭ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী। তিনি ঢাকার সাভারের জামিয়া ইসলামিয়া মারকাজুল উলুম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরও তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে পদ ধরে রাখতে পেরেছিলেন।

২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য পদে রয়েছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ। একই সঙ্গে তিনি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন। বেসরকারি হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য বেশ জনপ্রিয়।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের জ্যেষ্ঠ ইমাম মুফতি মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকীও ২০১৭ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ বোর্ডে রয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইউনিয়ন ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য সচিব ছিলেন। শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও তিনি এ ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ডে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন। সদস্য হিসেবে আছেন এক্সিম ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডে।

বর্তমানে ৯৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে ধুঁকতে থাকা ইউনিয়ন ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মো. মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী। একই সঙ্গে তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা এ শিক্ষক গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তিনটি ব্যাংকেরই শরিয়াহ বোর্ড থেকে বাদ পড়েছেন।

দীর্ঘ দিন ধরে এক্সিম ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকার বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু নোমান মো. রফিক রহমান। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও তিনি একই পদে রয়েছেন। শরিয়াহভিত্তিক এ ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার, যিনি প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন।

কোনো বিষয়ে কমিটি থাকলে সে কমিটির দায়ও থাকা উচিত বলে মনে করেন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পুনর্গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন। জ্যেষ্ঠ এ ব্যাংকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ কমিটি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন। কমিটির সদস্য হিসেবে তারা সম্মানী পান। তাহলে দায়-দায়িত্ব থাকবে না কেন? এ ব্যাংকগুলোতে সংগঠিত অনিয়ম-দুর্নীতির দায় তাদের ওপরও বর্তায়। পর্ষদ পুনর্গঠনের পর আমরা শরিয়াহ কমিটির কয়েকজন সদস্য পরিবর্তন করেছি।’

গত এক দশক শরিয়াহ বোর্ডগুলোর সঙ্গে কাজ করা একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও কর্মকর্তারা জানান, শরিয়াহ বোর্ডের কিছু সদস্যের বিতর্কিত ভূমিকা পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে উৎসাহিত করেছে। আইন অনুযায়ী শরিয়াহ বোর্ডের সভায় উপস্থিতির জন্য প্রত্যেক সদস্য ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা সম্মানী পান। কিন্তু কিছু সদস্য সভায় উপস্থিতির জন্য ৫০ হাজার টাকা সম্মানী নিতেন। তাদেরকে দেয়া সম্মানির অর্থ ভুয়া ভাউচার ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংকের অন্য খাতে দেখাতে হতো। আবার শরিয়াহ বোর্ডের অনেক সদস্য নিয়োগ ও কেনাকাটায় তদবির করতেন। কোনো বিতর্কিত বিনিয়োগের (ঋণ বিতরণ) বিষয়ে মতামত চাওয়া হলে শরিয়াহ বোর্ড থেকে এমনভাবে মতামত দেয়া হতো, যাতে দ্রুত বিনিয়োগটি ছাড় হয়।

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের জাকাত তহবিলের ২০০ কোটি টাকা সরকারের মডেল মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছিল। অথচ জাকাতের টাকা কখনই মসজিদে দান করা যায় না। এক্ষেত্রে শরিয়াহ বোর্ড কোনো আপত্তি করেনি। আমানত সংকট শুরু হওয়ার পর ছয় বছরে দ্বিগুণ মুনাফার একটি আমানত প্রডাক্ট চালু করা হয়েছিল, যা ছিল সুস্পষ্টভাবে শরিয়াহবিরোধী। কিন্তু এক্ষেত্রেও ওই সময়কার শরিয়াহ বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে।’

শরিয়াহবিরোধী এসব কর্মকাণ্ড অনুমোদনের ক্ষেত্রে অবশ্যই শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদের দায় আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দায়দায়িত্ব আইন কিংবা নীতিমালায় উল্লেখ থাকে না। কিছু জিনিস মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। দেশের সম্মানিত আলেমরা শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হন। এখন আইন করে যদি তাদের শাস্তি নির্ধারণ করতে হয়, তাহলে তো শরিয়াহ বোর্ডের কোনো মর্যাদা থাকল না।

আরিফ হোসেন খান আরো বলেন, ‘অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সম্প্রতি শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি গঠন ও দায়-দায়িত্বের বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আর ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ কমিটির কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি শরিয়াহ কমিটি গঠন করা হচ্ছে। আশা করছি, আগামীতে শরিয়াহ কমিটির কার্যক্রমও তদারকি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হবে।’