Image description
 

বাসায় টয়লেটে লাইটারের আগুন জ্বালাতেই বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দগ্ধ হন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতি বাবুল কাজী (৫৯)। শরীরের ৭৮ শতাংশ দগ্ধ হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে তিনি। শনিবার (১৮ জানুয়ারি) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর নিজ বাসায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রশ্ন উঠছে, বাসায় টয়লেটে কেন বিস্ফোরণ হলো? এটি তিতাস গ্যাস নাকি টয়লেটের জমাট বর্জ্য থেকে গ্যাস বিস্ফোরণ, নাকি অন্যকিছু!

বাবুল কাজী বনানীর ২৩ নম্বর রোডে ১০৯ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় থাকতেন। শনিবার বিকালে ওই বাড়িটি ঘুরে দেখা গেছে, ‘ডেল অ্যামর’ নামে পাচঁতলা বাড়ির চতুর্থ তলায় স্ত্রী নাদিরা ফারজানা রুনা ও দুই ছেলে-এক মেয়ে নিয়ে থাকতেন বাবুল কাজী। তিনি একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী।

ঘটনার বর্ণনা করে বাড়ির কেয়ারটেকার মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘ফজরের নামাজ পড়ার জন্য অজু করছিলাম। ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। প্রথমে ধারণা করেছি, পাশের নির্মাণাধীন বাড়িতে কিছুএকটা হয়েছে। পরে শুনি, আমাদের বাড়ির ভেতর থেকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার। এরমধ্যে বাবুল সাহেবের বড় ছেলে ওপর থেকে নিচে নেমে এসে বলছেন, আবার বাবার শরীরে আগুন লেগেছে। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স আনতে হবে।’

বাড়ির ম্যানেজার লাতিকুল বলেন, ‘বিস্ফোরণের কারণে ওই টয়লেটের জানালা ও কুলিং ফ্যান ভেঙে ছিটকে পড়ে যায়। পুলিশ আসার পর টয়লেট থেকে সিগারেটের ছাই, একটি ছোট গ্যাস লাইটার ও টয়লেটের পোড়া পয়দা পাওয়া গেছে।’

টয়লেটের নিচ দিয়ে তিতাস গ্যাস লাইন নেওয়া হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে ম্যানেজার লাতিকুল বলেন, ‘এই বাড়ির প্রতিটা ফ্লোরে দুটি করে ফ্লাট। গ্যাসের লাইন গেছে ভবনের মাঝখান দিয়ে। আর যে টয়লেটে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটি বাড়ির একপাশে। রান্নাঘর থেকে টয়লেটের দূরত্ব প্রায় ৩০ মিটার। তিতাস গ্যাসের লাইন বা তিতাস গ্যাস জমার কোনও সুযোগ নেই।’

বাবুল কাজীর বড় বোন খিলখিল কাজী বলেন, ‘তার ভাইয়ের ধূমপানের অভ্যাস রয়েছে। মাঝেমধ্যে তিনি বাসায় টয়লেটে গিয়ে সিগারেট খেতেন। শনিবার ভোরে বাথরুমে গ্যাস লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ হয়। তখন তিনি নিজেই বাথরুমের দরজা খুলে বাইরে বের হন। স্ত্রী-সন্তানরা মিলে তাকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, বাথরুমে মিথেন গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে।’

এ বিষয়ে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.রাসেল সারোয়ার বলেন, ‘বাবুল কাজী যে বাড়িতে থাকেন, ওই বাড়িটি অনেক সিকিউরিটিপূর্ণ। সেখানে বহিরাগত কোনও মানুষের যাতায়াতের সুযোগ নেই। আমরা তদন্ত করার জন্য বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডের কাছে নাম লিপিবদ্ধ করে তারপর ওপরে উঠেছি। যে টয়লেটে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখানে তিতাস গ্যাসের কোনও সংযোগও নেই। তবে টয়লেটের ভেতর থেকে সিগারেটের ছাই ও লাইটার উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া অন্য কোনও আলামত পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, টয়লেটের বর্জ্য থেকে জমাট মিথেন গ্যাসের কারণে বিস্ফোরণ হতে পারে। তবুও বিষয়টি আরও তদন্ত করা হচ্ছে।’

দগ্ধ বাবুল কাজীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মো. মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘তার শরীরের ৭৪ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্বাসনালী। বর্তমানে তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইতোপূর্বে বাবুল কাজীর লিভার ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে। তার সার্বিক চিকিৎসার জন্য গঠন করা হয়েছে ১৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড।’

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ মে গুলিস্তানে সিদ্দিকবাজারে একটি টাইলস মার্কেটের ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেপে উঠে পুরো এলাকা। এ ঘটনায় রাস্তার পথচারী শিশু-নারীসহ ২৩ জন নিহত হন। তবে সেদিন কোনও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। ঠিক একই রকম এবং এর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটে একটি রেস্টুরেন্টে। সে সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে আশেপাশের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা কেঁপে উঠে। ওই ঘটনায় ১২ জন নিহতের পাশাপাশি অন্তত শতাধিক মানুষ আহত হন।

২০১৫ সালে ২২ এপ্রিল রাজধানীর মালিবাগে একটি বিপণিবিতানের টয়লেটে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে বশির আহমেদ (৫৮) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর শনির আখড়ায় একটি বাসার টয়লেটে বৈদ্যুতিক সুইচের স্পার্ক থেকে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয় মৌমিতা (১৩) নামে এক শিক্ষার্থী। পরে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে বাঁচার উপায় কী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক গ্যাসে গন্ধ থাকে না। প্রাকৃতিক গ্যাস ও তার মূল উপাদান মিথেন গ্যাসের কোনও গন্ধ নেই। শহরের তরল বর্জ্য নর্দমা বা সুয়ারেজ লাইনে বিভিন্ন জৈবিক পদার্থের পচনের ফলে হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়াসহ আরও কিছু কিছু গ্যাস তৈরি হয়, যাকে বলা হয় ‘সুয়্যার গ্যাস’। এ দুটো গ্যাসেই গন্ধ আছে। অনেক সময় গ্যাসের পাইপ সুয়ারেজ লাইনের ভেতরে বা কাছেই থাকে। লিক করা প্রাকৃতিক গ্যাস তখন এ সুয়্যার গ্যাসকে নিয়ে বের হয় বিধায় গন্ধ পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসার প্রথমেই রান্নাঘরের সব দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে, যেন গ্যাস জমে থাকলেও তা বাইরে ছড়িয়ে যায়। এ জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করে এরপর বৈদ্যুতিক সুইচ ও রান্নঘরে চুলা জ্বালাতে হবে। দরজা-জানালা বন্ধ থাকলে জমে যাওয়া গ্যাস আগুনের ছোট একটি স্ফুলিঙ্গ পেলেই বোমার মতো কাজ করে। বিদ্যুতের লাইট, ফ্যান বা অন্য যেকোনও যন্ত্রপাতির সুইচ অন-অফ করলে সেখানে ছোট একটি স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়, যা অনেক সময় দেখা যায় না। কিন্তু জমে থাকা গ্যাসে তা বিস্ফোরণ ঘটায়। এমনকি ব্যাটারির টর্চলাইটের সুইচেও স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতে পারে। আর দেশলাই বা সিগারেটের লাইটারের আগুনে তো কথাই নেই। তবে মুঠোফোনের টর্চলাইটটি নিরাপদ, কারণ এটি ইলেকট্রনিক সুইচের মাধ্যমে অন-অফ করা হয় না। আর এতে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় না।

বুয়েটের অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘বিস্ফোরণ কমানোর একমাত্র উপায় হলো, গ্যাসের লাইন ঠিক রাখা, দেখা, চেক করা। বারবার দেখতে হবে এসব লাইন ঠিক আছে কিনা। গ্যাস লিকেজ হলে যেন ধরা যায়।’ প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে গন্ধযুক্ত কেমিক্যাল দেওয়ারও পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।

তিনি আরও বলেন, ‘আগে গ্যাসের সঙ্গে গন্ধ মেশানো হতো, গ্যাস লিকেজ হলে আমরা গন্ধ পেতাম। এখন সেটা পাই না। গন্ধ না থাকার কোনও কোথাও গ্যাস জমাট থাকলে ধরা যায় না। ঘরে যদি গ্যাস জমে থাকে, আর গন্ধ না পাওয়া যায়, তাহলে প্রথমে আগুন জ্বালানো বা ইলেট্রনিক সুইচ না দিয়ে, দরজা-জানারা খুলে বাইরের আলো বাসাত ঘরে আনতে হবে।’

বুয়েটের পুর কৌশলের অধ্যাপক ড. মেহেদী বলেন, ‘বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেকিংয়ের মধ্যে থাকতে হবে। কারণ বিল্ডিং আবাসিক হওয়ার কথা, কিন্তু কমার্শিয়াল ইউজ করেছে। একটি বাসায় একটা এসি থাকার কথা, বাস্তবে পাঁচটা এসি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে, টয়লেট, ভেন্টিলেশন কিংবা ময়লা জমে থাকা বাড়ির আঙিনায় সিগারেট বা আগুন জ্বালানো মতো কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভবনের ভেতরে কাঠামো, ফায়ার ও ইলেকট্রিক সিস্টেম এবং সার্ভিসেস-গ্যাস সাপ্লাই, প্লাম্বিং (পয়ঃনিষ্কাশন) এসব সবসময় চেক করতে হবে। রি সার্টিফিকেশন করতে হবে। বিশেষ করে বদ্ধ জায়গায় কখনই আগুন জ্বালানো যাবে না।’