
রোকন উদ্দিন আহমেদ। সরকারি চাকরিজীবী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। গত ৭ সেপ্টেম্বর ভাগ্নির জন্য জন্মসনদ নিতে যান অঞ্চল-৩-এর অফিসে। সেখান থেকে আঞ্চলিক অফিস, নগর ভবন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘুরেছেন। শেষে খিলগাঁওয়ে অবস্থিত অঞ্চল-২-এর কার্যালয় থেকে সনদ হাতে পান।
জন্মনিবন্ধন করতে হয়রানির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আমার দেশকে রোকন উদ্দিন আহমেদ বলেন, কদিন ধরে বিভিন্ন কার্যালয়ে জন্মসনদ করার জন্য ঘুরেছি। সিটি করপোরেশন অফিস থেকে আবেদন করা যায় না, বাইরে থেকে করা লাগে। অথচ এই কাজগুলো তাদেরই। অনলাইনে আবেদন করে দিতে বললে তারা নানা তালবাহানা করে। পরে দোকান থেকে আবেদন করি। আঞ্চলিক কর্মকর্তার স্বাক্ষর নিতে গেলেও ঝামেলায় পড়ি। এক ভবন থেকে অন্য ভবনে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, অঞ্চল-৩ থেকে নগর ভবনের ১৫ তলায় যেতে বলা হয়, সেখানেও যাই। কিন্তু বর্তমানে জন্মনিবন্ধনের কোনো কার্যক্রম সেখানে নেই। আবেদনে ভুল থাকায় তার সুরাহা হয়নি। পরে ভুল সংশোধনের জন্য সেখান থেকে আবার অঞ্চল-২-এ আসতে হয়। অনলাইনে সংশোধনের পর তা অনুমোদনের জন্য আবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যেতে বলা হয়।
তিনি আরো বলেন, নির্ধারিত ফরমে জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেও সনদ পেতে দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে। এতসব হয়রানি কোনোভাবেই আমাদের কাম্য নয়।
শুধু রোকন উদ্দিন আহমেদ নন, জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে এভাবে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। মূলত অপ্রতুল জনবল ও জটিল নিয়মের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরেজমিনে ঢাকা সিটির বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয় ঘুরে এমন দুর্ভোগের চিত্র চোখে পড়ে।
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জমি রেজিস্ট্রি, বিবাহ নিবন্ধন, মৃত্যুর সনদ গ্রহণ, পাসপোর্ট তৈরিসহ ১৯টি সেবা পেতে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ১০টি ওয়ার্ড নিয়ে একটি আঞ্চলিক জোন গঠিত। সেজন্য ১০টি অফিসে প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক মানুষ একটি অফিসেই সেবা নিতে আসেন। জনবলের অভাবে জন্মনিবন্ধনের পর্যাপ্ত সেবা পাচ্ছেন না সেবাগ্রহীতারা। তাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়া জন্মনিবন্ধন ভুল সংশোধনীর জন্য সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিস ও ডিসি অফিসে কয়েক দফা ঘুরেও সহজে সনদ মেলে না বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
রাজধানীর মিরপুর-১০-এর আঞ্চলিক অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে বা নামের সংশোধন করতে সেখানে আসছেন। কেউ কেউ আবার জন্মনিবন্ধন ওয়েবসাইটে বা অনলাইনে আপডেট না থাকায় তাও করতে আসছেন। ফলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিসের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে মানুষের জটলা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
সরেজমিনে ৭ সেপ্টেম্বর সেখানে আসা লোকজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, অনেকে এক যুগ আগে হাতে লেখা জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ওয়েবসাইটে ওই তথ্য মিলছে না। আবার অনেকে অনলাইন সনদ নিয়েছিলেন। কিন্তু সনদ নম্বর ১৭ ডিজিটের কম, তাদের তথ্যও ওয়েবসাইটে নেই। আবার ওয়েবসাইটে কিছু জন্মনিবন্ধন পাওয়া গেলেও সেটির নামের বানান বেশিরভাগই ভুল করে ওঠানো হয়েছে। আবার ওই বানান বা ছোটখাটো সংশোধনী করতে গেলে শুরু হয় আরো ভোগান্তি। সেক্ষেত্রে প্রথমে আঞ্চলিক অফিস এবং পরে তা নিয়ে ডিসি অফিসে যেতে হয়।
কল্যাণপুর ১১ নম্বর ওয়ার্ডে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, জন্মনিবন্ধন কাজে নাগরিক সেবা দেওয়ার জন্য ওয়ার্ড অফিসগুলোতে কম্পিউটার, প্রিন্টার, কাগজ দেওয়া হয়নি। সে সঙ্গে নেট বিল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় নাগরিক সেবা প্রদানে বিঘ্ন ঘটছে। এসব কারণে ওয়ার্ড সচিবদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড পর্যায়ে বিদ্যমান এ সমস্যাগুলো সম্পর্কে আঞ্চলিক কর্মকর্তাসহ প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সবাই জানেন। কিন্তু জেনেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় নাগরিকরা সেবা নিতে এসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আমরাও সময়মতো সেবা দিতে না পেরে সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছি।
শুরুতে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন হাতে লেখা জন্মনিবন্ধন সরবরাহ করত। ২০০৬ সালে এসে অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা শুরু হয়। ২০১১ সালের নভেম্বরে জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধনের নতুন ওয়েবসাইট ও সার্ভার চালু করা হয়। যার কার্যক্রম ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়। তারপর অনেকেই পুরোনো জন্মনিবন্ধন সনদ নতুন ওয়েবসাইটে যুক্ত করে নিয়েছেন। পাশাপাশি কিছু ইউনিয়ন পরিষদ আগের হাতে লেখা সনদের তথ্য ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করে। তবে বেশিরভাগই হালনাগাদ করা হয়নি। ২০১২ সালে চালু হওয়া ওয়েবসাইটটি ২০২০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ফের নতুন ওয়েবসাইট চালু হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকে অভিযোগ করেছেন তারা আগে জন্মনিবন্ধন করলেও ওই তথ্য বা জন্মনিবন্ধনের তথ্য ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে না। আবার অনেকের ওয়েবসাইটে উঠলেও তাতে অসংখ্য বানান ভুল রয়েছে।
জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ অনলাইনে হচ্ছে। দিনে গড়ে ২০ হাজার জন্মনিবন্ধন হয়। মৃত্যুনিবন্ধন অনেক কম হয়।
গত ৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় রাগে চিৎকার করে ডিএসসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়-৪ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন মানিকনগর লেনের বাসিন্দা শরীফ। জন্মনিবন্ধনে তার বাবার নাম সংশোধন করার জন্য ১০ দিন ধরে এ কার্যালয়ে ঘুরছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। একদিন গেলে বলা হয় হোল্ডিং ট্যাক্সের ফটোকপি লাগবে, আরেকদিন বলে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন লাগবে। এভাবে দিনের পর দিন কাগজপত্র নিয়ে ঘুরছেন এই আঞ্চলিক অফিসে। এ অফিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা তার আবেদনটি গ্রহণ করেননি। তারা বলছেন, নতুন করে জন্মনিবন্ধন আবেদন করতে হবে। তাই রাগে-অভিমানে চিৎকার করে বের হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমার আবেদন যদি গ্রহণ না করে, তাহলে আমাকে কেন এতদিন ধরে বিভিন্ন কার্যালয়ে ঘোরানো হলো। আমি তো বাবার নাম সংশোধন করার জন্য আবেদন করেছি। তাহলে আমার আবেদন গ্রহণ করবে না কেন। এখানে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছেÑআর কিছুই না। আমার সবকিছুই ঠিক আছে। শুধু বাবার নামের শেষে আলম বসবে। এর জন্য আমার জন্মনিবন্ধন বাদ দিয়ে নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে হবে। শুধু শরীফ নন, এমন অনেক বাসিন্দা জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। সরেজমিনে বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয় গিয়ে দেখা গেছে এসব দৃশ্য।
এছাড়া স্কুলে ভর্তির সময় শিশুদের জন্মসনদ চাওয়া হয়। একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ছোটখাটো সংশোধনের জন্যও দিনের পর দিন ঘোরানোয় সময় অপচয় হয়। প্রয়োজনীয় কাজে জন্মনিবন্ধন জমা দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবার জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে নামের মিল নেই জাতীয় পরিচয়পত্রের। এক্ষেত্রে শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে প্রথম ধাপে সংশোধন করতে হয় মা-বাবার নাম। ভোগান্তিটা এখান থেকেই শুরু। অন্যদিকে শিশুর বাবা প্রবাসে থাকায় পাসপোর্টের নামের সঙ্গে অনেকের মিলছে না জন্মনিবন্ধনের নাম। এতে অভিভাবকদের আরেক ধাপ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৪-এর কার্যালয়ের ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিবন্ধক তুফানী লাল রবি দাস আমার দেশকে বলেন, সেবাগ্রহীতারা বাইরে থেকে অনলাইনে আবেদন করে কাগজপত্রসহ এলে আমরা করে দিই। এখানে কোনো হয়রানি নেই। কাগজপত্র দিয়ে গেলে আমি তারিখ দিয়ে দিই। ১৫ দিন সময় লাগে হয়তো। জন্মনিবন্ধন কার্ড রেডি হলে মেসেজ যায়। মেসেজ গেলেই একদিন পর এসে নিয়ে যেতে পারে।
জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৬১ লাখ ৩৭ হাজার।
সম্প্রতি জাতীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস উপলক্ষে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ হাজার ২৪৬টি নিবন্ধন কার্যালয়ের ১০ হাজার ৪৯২ নিবন্ধক ও নিবন্ধন সহকারীর মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট জন্মনিবন্ধনের সংখ্যা ছিল ৭৭ লাখ ২৪ হাজার। আর মৃত্যুনিবন্ধনের সংখ্যা সাত লাখ ৪৫ হাজার। সনদ সংশোধনের সংখ্যা ২৫ লাখ ১৭ হাজার। প্রতিদিন গড়ে এক লাখ নাগরিক বার্থ অ্যান্ড ডেথ রেজিস্ট্রেশন ইনফরমেশন সিস্টেম (বিডিআরআইএস) থেকে সেবা নিচ্ছেন। সেবা নির্বিঘ্ন করার জন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে ২৫০ টেরাবাইট অতিরিক্ত স্টোরেজ কিনে সিস্টেমে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে নাগরিকদের জন্য এখন আবেদনের প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। বর্তমানে ডকুমেন্ট আপলোডে স্টোরেজ ১০ গুণ বাড়িয়ে ২০০ কিলোবাইটের জায়গায় দুই মেগাবাইট করা হয়েছে। এই দুই পরিবর্তনের কারণে সিস্টেমের গতি স্বাভাবিক হয়েছে। নাগরিকরাও সহজে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন।
জন্মনিবন্ধন করা কেন জরুরি
জন্মসনদ হলো একজন মানুষের জন্ম, বয়স, পরিচয় ও নাগরিকত্বের প্রমাণ। রাষ্ট্রের স্বীকৃত নাগরিকের মর্যাদা ও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে হলে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। ২০০৪ সালের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন অনুযায়ী, শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করাতে হবে। এ সময়ের ভেতর নিবন্ধন করলে কোনো ফি লাগে না। পাশাপাশি মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যুসনদ সংগ্রহের কথা বলা হয়। এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধন না করা হলেও ১৮ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এটি করা যাবে। তবে ১৮ বছর পার হলে ৫০ টাকা ফি দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।