Image description
 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ইউসুফ আলী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মনিরুল ইসলাম অনিয়ম ও দুর্নীতিতে কোটিপতি বনে গেছেন। বিধি ভেঙে শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ, পরীক্ষায় নকল ও প্রক্সি করার সুবিধা দিয়ে অর্থ আদায় অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।   

 

মনিরুল কলেজ ফান্ডের ৩ কোটি টাকাসহ ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়ে কলেজের এক অবসরপ্রাপ্ত অফিস সহায়ক রোববার প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

এ অভিযোগের অনুলিপি শিক্ষা উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধানদের কাছেও পাঠানো হয়েছে। অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ যুগান্তরের হাতে এসেছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, কেন্দ্রে নকল করার সুবিধা দেওয়ার শর্তে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায়, টেন্ডার ছাড়া কলেজের প্রাচীর, ছাত্রাবাস, ক্যান্টিন ও ভাস্কর্য নির্মাণে নয়ছয় করেছেন অধ্যক্ষ মনিরুল। কলেজের জমি ও বাগান লিজ, ছাত্র সংসদ ফি, ধর্মীয় ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান, ম্যাগাজিন, লাইব্রেরি এবং শিক্ষা সফরের অর্থও তিনি আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া সনদ ও প্রশংসাপত্রের ফি বাবদ বেশি অর্থ আদায়, হতদরিদ্র ছাত্রদের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে। চাকরিপ্রত্যাশীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে চাকরি না পেয়ে এখন তাকে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। এ নিয়ে সমঝোতা বৈঠকও হয়েছে। স্ট্যাম্পে মুচলেকা দিয়ে তিনি টাকা ফেরতের অঙ্গীকার করেছেন।

দুর্নীতির মাধ্যমে অধ্যক্ষ মনিরুল এক দশকের মধ্যে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। রাজশাহী শহরে তার জমিসহ তিনটি বাড়ি রয়েছে। ২০১৪ সালে তিনি অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন। কলেজ সরকারীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হলে তিনি সিন্ডিকেট তৈরি করে শিক্ষক ও কর্মচারীদের কাছ থেকে কোটি টাকা আদায় করেন। ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট কলেজটি জাতীয়করণ হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ছয়জন শিক্ষক এবং ৯ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে অধ্যক্ষ মনিরুল দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়া তিনজন ভুয়া কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তিনি ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নয়জন কর্মচারীর মধ্যে ছয়জনের নিয়োগ স্থায়ী হয়নি। এ কারণে তারা টাকা ফেরত চেয়েছেন। এ ঘটনায় ৬ সেপ্টেম্বর বৈঠকে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে মুচলেকা দিয়ে তিনি টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।

কলেজে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকেন্দ্রের সমন্বয়কারীর দায়িত্বে আছেন অধ্যক্ষ মনিরুল। এ উপকেন্দ্রে প্রতিবছর এইচএসসির দুইটি এবং ডিগ্রির তিনটি সেমিস্টারের পরীক্ষা হয়। নকল করার অনৈতিক সুবিধা দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীপ্রতি ৩০০ ও ৫০০ টাকা নেন। ১০ বছরে এ ধরনের অনৈতিক কাজ করে ৩ কোটি টাকা অবৈধভাবে তিনি আদায় করেছেন। অফিসের পিওন হান্নানের মাধ্যমে তিনি এ অর্থ নেন। এছাড়া প্রক্সির (একজনের পরীক্ষা অন্যজন দেওয়া) মাধ্যমে পরীক্ষার্থীপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে তিনি নিয়েছেন। অভিযোগ-প্রতি সেমিস্টারে ১৫ থেকে ২০ জন প্রক্সি পরীক্ষার্থী অংশ নেন। এ সুযোগ দিয়ে তিনি ১০ বছরে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর এ কাজে অধ্যক্ষকে সহায়তা করেছেন অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মাইনুল ইসলাম এবং ভূগোল বিভাগের মাসুদ রানা।

কলেজের এইচএসসি, ডিগ্রি ও অনার্সের প্রবেশপত্র, সার্টিফিকেট ও প্রশংসাপত্র বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তিনি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এক দশকে অনার্সের পাঁচটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছ ৩০ লাখ টাকা জরিমানা নিয়ে কলেজ ফান্ডে তিনি জমা দেননি। কলেজ ক্যাম্পাসের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ মনিরুল সীমাহীন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। টেন্ডার ছাড়া ২২ বিঘা আয়তনের ক্যাম্পাসের প্রাচীর নির্মাণে তিনি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন

২০১৭ থেকে ২০১৮ সালে নির্মিত এ প্রাচীর ইতোমধ্যে হেলে পড়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণও তিনি টেন্ডার ছাড়া কাজ করেছেন। ব্যয় দেখিয়েছেন এক কোটি টাকা। এর মধ্যে আত্মসাৎ করেছেন অর্ধকোটি। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ আলীর ভাস্কর্য নির্মাণে ৫০ হাজার এবং জিয়া ছাত্রাবাসের প্রাচীর নির্মাণে দুই লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। টেন্ডার ছাড়া ক্যান্টিন ও ১২টি দোকান ঘর নির্মাণে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ মনিরুল। এক দশকে দোকান ভাড়ার টাকা কলেজ ফান্ডে জমা না দিয়ে তিনি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

প্রভাষক মো. আপন, অফিস সহকারী বজলুর রহমান, গোবিন্দ ও অর্জুন নামে চারজনের বেতন কৌশলে উত্তোলন করে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন অধ্যক্ষ মনিরুল। অনার্সের খণ্ডকালীন শিক্ষকদের জাতীয়করণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রলোভন দিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে নিয়েছেন। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলেও টাকা ফেরত দেননি তিনি। কলেজের প্রতিটি ভবন এবং সীমানা প্রাচীর টেন্ডার ছাড়া রং করে দেড়গুণ ভাউচার করেছেন তিনি।

কলেজের এলইডি টিভি অধ্যক্ষ মনিরুল নিজের বাসায় নিয়ে গেছেন। বাসার পুরোনো সোফাসেট কলেজের গেস্টরুমে দিয়েছেন এবং সেটির ভাউচার করে টাকা নিয়েছেন। কলেজের প্রায় ২৫ বিঘা জমি, বাগান ও পুকুর লিজের টাকা কলেজ ফান্ডে জমা না দিয়ে তিনি আত্মসাৎ করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার বাসিন্দা অধ্যক্ষ মনিরুল রাজশাহী শহরে জমি কিনে তিনটি বাড়ি করেছেন। বাড়ি তিনটির বাজারমূল্য সাত কোটি টাকা।

ভোলাহাটের রহনপুর সোনালী ব্যাংক শাখায় তিন ছেলে-মেয়ের নামে প্রতিমাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ডিপিএস জমা দেন অধ্যক্ষ মনিরুল। পোস্ট অফিসে অধ্যক্ষ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৩০ লাখ টাকার ডিপিএস খুলেছেন। অধ্যক্ষ মনিরুল ইসলাম বলেন, যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন। আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার সব সম্পদ বৈধ। অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে আমি কোনো সম্পদ করিনি। একজন সরকারি চাকুরে হিসাবে কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন-প্রশ্ন করা হলে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে বলেন, কলেজে আসেন। চা খাওয়ার দাওয়াত রইল। তখন এ বিষয়ে কথা বলা যাবে।