Image description

ঢাকা শহরের তরুণেরা (১৮-৩৫) দৈনিক ৫-৮ ঘণ্টা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) ব্যয় করেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আইসিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (বিআইআইডি) পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এ কারণে প্রতিবেদনে ‘ঢাকাকে ফেসবুকের নগরী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ডাটা-রিপোর্টাল এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ফেসবুক বিজ্ঞাপন প্রায় ২.৯৯ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে ঢাকায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিল্লি, হো চি মিন ও ব্যাংককের মতো বড় শহরগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। 

বিআইআইডি’র গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৪.৫ কোটিরও বেশি ব্যক্তি সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন; যাদের বেশির ভাগের বয়সই ৩৫ বছরের কম। তারা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফেসবুক বা টিকটক দেখা একটি অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। অন্যদিকে ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা দৈনিক ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় ফেসবুকে ব্যয় করেন করেন বলেও ওই গবেষণায় উঠে এসেছে। যার বার্ষিক সময় দাঁড়ায় প্রায় ১,৮২৫ থেকে ২,৯২০ ঘণ্টা।  

এই অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার সময় অপচয়ের পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে তরুণ-তরুণীরা তাদের এই মূল্যবান সময় এভাবে অপচয় না করে নিজেদের ক্যারিয়ার উন্নয়নে কীভাবে ব্যবহার করতে পারেন। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এই সময়ের মধ্যে একটি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়।  

মাস্টার্স ডিগ্রি করতে কত সময় লাগে?
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স প্রোগ্রামগুলো সাধারণত ১-২ বছর মেয়াদি হয়ে থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে  ৪ বছর মেয়াদি স্নাতক সম্পন্নের পর ১ বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোগ্রাম থাকে, যা সাধারণত ৩৬ থেকে ৪০ ক্রেডিটের হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ( ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি) প্রায় একই নিয়ম অনুসরণ করে।

প্রতি ক্রেডিট সমান ২৫ থেকে ৩০ ঘণ্টার কাজ (পড়ালেখা, ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট, পরীক্ষা)। অর্থাৎ, একটি ৩৬ ক্রেডিটের প্রোগ্রাম সম্পন্ন করতে প্রায় ১,০০০ থেকে ১,২০০ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়।

 

প্রফেশনাল প্রোগ্রামসমূহ যেমন, এমবিএ বা এমপিএইচ সাধারণত একটু দীর্ঘ সময়ের হয়। এগুলোর জন্য সাধারণত ৪৮ থেকে ৬০ ক্রেডিট প্রয়োজন হয়ে থাকে। অর্থাৎ, মোট কাজের প্রায় ১,৫০০ থেকে ১,৮০০ ঘণ্টা। কিছু মেডিকেল বা পাবলিক হেলথ প্রোগ্রামের ক্রেডিট ৭০-এর কাছাকাছিও হয়, যা ২,০০০ ঘণ্টার বেশি ক্লাসে ও পড়াশোনায় ব্যয়কৃত সময়কে বোঝায়।

সহজ ভাষায় বলা যায়, প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে চার ঘণ্টা ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও পড়াশোনায় ব্যয় করলে সঠিক সময়ের মধ্যে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। এই সময়ের হিসাব অন্যান্য আন্তর্জাতিক মাস্টার্স ডিগ্রির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

ফেসবুকে ব্যয়কৃত সময় বনাম পড়াশোনার সময়:
তরুণ-তরুণীদের ফেসবুক ব্যবহারের এই সময়টা বেশিরভাগ মাস্টার্স প্রোগ্রাম শেষ করার জন্য যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ২ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন, তাহলে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা সাশ্রয় হয়। এক বছরে এই সাশ্রয়কৃত সময় দাঁড়ায় প্রায় ১,৪০০ ঘণ্টা, যা এক বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য যথেষ্ট। এমনকি ছোট পরিবর্তনও বড় প্রভাব ফেলে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার কমানো মানে বছরে ৩৬৫ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় পাওয়া যায়। দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে এটিই একটি সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য যথেষ্ট। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের দেশে কোনো ধরনের গাইডলাইন ছাড়াই ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যক্তির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে তা জানার আগেই তারা এগুলোর ব্যবহার শুরু করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উদ্দেশ্যহীন ভাবে ফেসবুক ব্যবহারে কাটিয়ে দেন তারা। ফেসবুকের এই অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের খাওয়া, ঘুমসহ তাদের দৈনন্দিন জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার প্রভাব একাডেমিক রেজাল্টের ওপরও পড়ে। 

ফেসবুকে ব্যয়কৃত সময়কে কেন পড়ালেখায় রূপান্তর করা যায় না?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয়কৃত সময়কে পড়াশোনার সময়ে রূপান্তর করা কঠিন। মানুষ সাধারণত ছোট ছোট বিরতিতে যেমন বাস/ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময়, খাওয়ার সময় বা ঘুমানোর আগে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। কিন্তু পড়াশোনার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় পরিবেশ। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামগুলো নির্দিষ্ট রুটিনে চলে। ক্লাস, পরীক্ষা এবং অ্যাসাইনমেন্ট কয়েক মাসব্যাপী হয়ে থাকে। দীর্ঘ সময় একাডেমিক কাজে যুক্ত থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একঘেয়েমি ভাব চলে আসে। এটা কাটাতে অনেকে বিনোদনের জন্য ফেসবুক ব্যবহার করে। কিন্তু ফেসবুকে একবার ঢুকলে একের পর এক কন্টেন্টে আটকে যান তারা। নিজের অজান্তেই দীর্ঘ সময় ফেসবুকে ব্যয় করেন।

মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সঞ্চারী প্রতিভা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমানে যেকোনো নিউজ বা বিনোদনের জন্য ফেসবুক খুব ইজি এক্সেস। এখন মানুষ পত্রিকা না পড়ে মোবাইলে ফেসবুকেই নিউজ পড়ে নিতে পারে খুব সহজে। বিনোদনের ক্ষেত্রেও তাই। একটি একটা রিল দেখতে দেখতেই আরেকটি চলে আসে। তাছাড়া বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভাইরাল ইস্যু তৈরি হচ্ছে যেমন কোনো ইস্যু বা কারও ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে পক্ষ বিপক্ষ তৈরি হচ্ছে। 

তিনি বলেন, এটা তরুণদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহের সৃষ্টি করে। তারা এর আপডেট জানার জন্য বা কোন পক্ষ কী স্ট্যাটাস দিচ্ছে, তাতে কে কী কমেন্ট কী কমেন্ট করছে—এসব জানার জন্য তারা মুখিয়ে থাকে; একটু পর ফেসবুকে ঢুঁ মারে। আর একবার ঢুকলে একের পর এক কন্টেন্ট দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়।    

কীভাবে এটি কার্যকর করা যায়? 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করার পরিবর্তে স্ক্রিন টাইম সীমিত করা বা নোটিফিকেশন বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে পড়ালেখার জন্য প্রয়োজনীয় সময় বের করা যাবে। ফেসবুকের ব্যবহার দৈনিক দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনতে পারলে দুই বছরে ১৪০০ ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে যা অধিকাংশ মাস্টার্স ডিগ্রির সময়ের সমান।    

অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার কীভাবে কমানো যায় জানতে চাইলে অধ্যাপক সঞ্চারী প্রতিভা বলেন, ফেসবুক যদি মোবাইলে ব্যবহার করা না যেত, যদি এটি যদি শুধু ল্যাপটপে ব্যবহার করতে হতো তাহলে ফেসবুকের ব্যবহার অনেকটা কমে যেত। সোশাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ অ্যাপ ব্যবহার করলেও ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার কমানো যায়। এছাড়া ফেসবুকের নোটিফিকেশন বন্ধ রাখলেও ফেসবুক ব্যবহার কিছুটা কমবে। ফেসবুক আসক্তি বেড়ে গেলে কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিতেও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাস, সাপ্তাহিক কোর্স বা সন্ধ্যাকালীন প্রোগ্রাম চালু করে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত সময়সূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সহায়তা করতে পারে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হাইব্রিড মডেল গ্রহণ করার—যেখানে অ্যাসাইনমেন্ট, দূরশিক্ষণ এবং সরাসরি ক্লাস একসাথে মিশে একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। ব্র্যাক বা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এর মতো অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই এই সুবিধা দিচ্ছে (বিশেষ করে মহামারির সময় অনলাইন শিক্ষার প্রসারের পর থেকে)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের আরেক অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম এই বিষয়ে কাঠামোগত সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ২০১৭ সালের একটি ইউরোপীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্টারনেট প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপব্যবহৃত হয়, অথচ এটি উন্নত শিক্ষার জন্য দূরশিক্ষণসহ অনেক ভালো কাজে লাগানো যেতে পারে। সরকার এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছে এবং আমাদের আইসিটি নীতিমালাও অনলাইন শিক্ষাকে অনুমোদন দেয় না।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিনের জন্য অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হলেও পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অদক্ষতার কারণে লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস) এখনো ঠিকভাবে চালু হয়নি, ফলে আমরা এখনও ফেস টু ফেস শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উপযোগী অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক বা উদ্ভাবনী শিক্ষা মডেল তরুণদের আরও ভালোভাবে শিক্ষায় যুক্ত করতে পারত। যুক্তরাষ্ট্রের ল্যামার ইউনিভার্সিটি প্রায় ১,১০০ শিক্ষার্থীর ওপর দূরশিক্ষণের মাধ্যমে গবেষণা চালিয়েছে। তারা জানিয়েছে এই মডেল কার্যকর, এবং আমি বিশ্বাস করি ইউরোপিয়ান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যকে সমর্থন করি।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগী করতে সরকারের উচিত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পক্ষ থেকে ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া। অন্তত রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ফেসবুক বন্ধ রাখা উচিত

এ বিষয়ে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি সমন্বিত নীতিমালা দরকার। একাডেমিক বা ফরমাল এডুকেশনের সাথে নন ফরমাল এডুকেশন (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) যুক্ত করতে পারলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতো। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন ভাষা শিখতে ও নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, সেইসঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে।