
খাদ্য অধিপ্তরের পরিচালক জহিরুল ইসলাম খান একই সঙ্গে স্ত্রী শারমিন আক্তার এবং স্ত্রীর আপন ভাগ্নী দু’জনকেই বিয়ে করেছেন। খালা-ভাগ্নী উভয়ে জহিরুলের স্ত্রী। বিভিন্ন সময়ে দু’জনকেই একাধিকবার তালাকও দিয়েছেন তিনি। তালাকের পরে তাদের নিয়ে আবার সংসারও করছেন। পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার এ ধরনের অনাচার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড খাদ্য অধিদপ্তরে মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অবাক ব্যাপার হলো, আদালতে নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের এবং স্ত্রী কর্তৃক উত্থাপিত আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যেই তিনি আবার অতিরিক্ত পরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতিও পেয়েছেন। এ ধরনের গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিয়ে খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান এবং উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার তাকে এই পদোন্নতি দিয়েছেন। উপদেষ্টা এবং সচিবের প্রশ্রয়েই এমন বেপরোয়া অনাচার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন জহিরুল ইসলাম খান, বলছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
স্ত্রীর বড় বোনের মেয়ে শাহানা আক্তার স্বর্ণার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে গোপন পরকীয়া সম্পর্কে জড়ান জহিরুল ইসলাম খান। এক পর্যায়ে শাহানা আক্তার স্বর্ণাকে গোপনে বিয়েও করেন। একই সঙ্গে দু’জনের সঙ্গেই সংসার করছিলেন। ঘটনা ধরা পড়ে গেলে স্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ হয়। স্ত্রীর ওপর শারীরিক নিপীড়ন নির্যাতনও চালান। স্ত্রী শারমিন আক্তার এ নিয়ে নারী নির্যাতনের ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন ঢাকার সিএমএম আদালতে। ফৌজদারি মামলার কপিসহ তিনি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। সরকারের এ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী স্ত্রী কর্তৃক নারী নির্যাতনের ফৌজদারি মামলা দায়ের এবং মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত এবং পরে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সচিব এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই নেননি। তিনি অভিযোগপত্রটি নিয়ম বহির্ভুতভাবে পাঠিয়ে দিয়েছেন অধিদপ্তরে। জহিরুল ইসলাম খান তখন খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) পদে ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো রকমের ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা একমাত্র মন্ত্রণালয়েরই। অধিদপ্তরের কিছুই করার নেই। এই পর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অধিদপ্তরে কোনো অভিযোগ জমা পড়লে সেটিও মন্ত্রণালয়েই পাঠিয়ে দেয়ার কথা। অথচ সেক্ষেত্রে সচিব পাঠিয়েছেন উল্টো অধিদপ্তরে, যাদের আসলে এ বিষয়ে কোনো কিছুই করার ক্ষমতা নেই। বস্তুত, জহিরুল ইসলাম খানের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ খেয়ে সচিব অভিযোগটিকে ডিফ ফ্রিজে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। সচিবের ইঙ্গিতে ডিজি মো. আবুল হাছানাত হুমায়ূন কবীর অভিযোগটি এমন কর্মকর্তার হাতে দিয়েছেন যিনি নিজে সরাসরি জহিরের এক ধাপ উপরের বস এবং একই সিন্ডিকেটের সদস্য। জহির ছিলেন ওই সময় অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) পদে, আর এই কর্মকর্তা মো. জামাল হোসেন ছিলেন পরিচালক (প্রশাসন) পদে (বর্তমানে যিনি অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদে আছেন)। সারাদেশে বদলি-পদায়ন বাণিজ্যে একে অন্যের সহযোগী। ফলে সচিব মাসুদুল হাসানের ইচ্ছে অনুযায়ী তদন্তটি ডিফ ফ্রিজেই ঢুকে পড়ে।
জানা যায়, এই সময় বিচার পাওয়ার আশায় নির্যাতিত শারমিন আক্তার মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং অধিদপ্তরে মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ই বিচার বা আইন প্রয়োগ চায় না, তাই অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কারো এ বিষয়ে কিছুই করার ছিল না। মহাপরিচালক আবুল হাছানাত হুমায়ূন কবীর এবং পরিচালক জামাল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাত করলে এরা উল্টো জহিরের পক্ষ নিয়ে শারমিন আক্তারকে ভয়ভীতি দেখান বলে জানা যায়। শারমিন আক্তারকে এরা জহিরের সব অপকর্ম মেনে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। আপন বড় বোনের মেয়ে নিজের সতীন- এ অনাচার কীভাবে মানবেন শারমিন আক্তার, অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে শারমিন আক্তারের ওপর জহিরুল ইসলামের উৎপাত আরো বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে স্ত্রীকে তালাকও দেন জহির।
এরপরে অনন্যোপায় হয়ে লিখিত অভিযোগ নিয়ে উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের দ্বারে যান শারমিন আক্তার। এর আগেও তিনি উপদেষ্টার কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন যেহেতু সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন, আশা করছিলেন সচিব ব্যবস্থা নেবেন এবং তা স্বাভাবিক নিয়মে উপদেষ্টার কাছে আসবে বলে জানানো হয় তাই ওই সময় আলাদাভাবে আর লিখিত অভিযোগ দেননি। পরবর্তীতে তালাক পাওয়ার পরে সব হারিয়ে বাধ্য হয়ে উপদেষ্টার কাছেও আলাদা লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।
উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগে তিনি জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারি পদে থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ অর্থ উপার্জনের তথ্যও তুলে ধরেন। অভিযোগপত্রে শারমিন আক্তার লিখেন, “মো. জহিরুল ইসলাম খান, অতিরিক্ত পরিচালক, প্রশাসন বিভাগ, খাদ্য অধিদপ্তরে কর্মরত আছেন। তিনি আমাকে অনেকবার নির্যাতন করেছেন। তিনি দুর্নীতির অন্যতম হোতা। প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর মেয়ের জামাই আবু নাসের বেগ ও মেয়ে তৃনার সহযোগিতায় দুর্নীতির এক স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন। টাকার গরমে তিনি আমার বড় বোনের মেয়েকে বিবাহ করেন। বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন, কোটি টাকার ফার্নিচার দিয়েছেন, একটি গাড়িও কিনে দিয়েছেন। আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী থাকাকালে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। যে কারণে তাকে আগস্টের পর পরই রাজশাহী থেকে প্রত্যাহার করে খাদ্য ভবনে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। অবৈধ টাকার গরমে আমাকে মারধর, নির্যাতন এবং এখন তালাকও দিয়েছেন। এক্ষণে, তার দুর্নীতি, অনাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসাবে তার ভূমিকা ও স্ত্রীকে নির্যাতনের বিষয় তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অনুরোধ করা হলো।”
এ অভিযোগের পর উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার আশ^াস দিয়েছিলেন ব্যবস্থা নেবেন। পরে দেখা গেলো, তিনিও পরে জহিরের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ম্যানেজ হয়ে গেছেন। গত আগস্টে জহিরুল ইসলাম খানকে অতিরিক্ত পরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতির বিষয়ে ডিপিসির (বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির) সিদ্ধান্তের নথি শুরুতে আলী ইমাম মজুমদার আটকে দিয়েছিলেন। নথিতে তিনি শারমিন আক্তারের গুরুতর অভিযোগের কথাও তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু জহিরুল ইসলাম মন্ত্রণালয়ে এসে উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাত ও লেনদেনের কমিটমেন্ট চূড়ান্ত করার পর উপদেষ্টা আলী ইমাম নথিটি পুনরায় ডেকে নিয়ে জহিরের পদোন্নতি অনুমোদন করেন। সচিব মাসুদুল হাসান এসব লেনদেনে মূল ভূমিকা রাখেন।
সর্বশেষ জানা গেছে, নানামুখী চাপে পড়ে শারমিন আক্তার রাজি হয়েছেন আপন ভাগ্নীকে সতীন হিসেবে মেনে নিয়ে সংসার করতে। এদিকে ছেলে-মেয়ের চাপে পড়ে জহিরুল ইসলাম খানও তালাক দেয়া স্ত্রীকে ঘরে তুলতে রাজি হয়েছেন এবং শারমিনের সঙ্গেও সংসার করছেন। অন্যদিকে শারমিনের ভাগ্নী শাহানা আক্তার স্বর্ণার সঙ্গে আলাদা সংসার চলাকালে মাঝে এক দফায় তালাক হয়। তালাকের কিছুদিন পরে তা আবার মিটমাটও হয়েছে। এখন উভয়ের সঙ্গেই আলাদা সংসার চলছে জহিরুলের। একদিকে খালা-ভাগ্নী উভয়েই স্ত্রী, আবার উভয়েই এক দফা করে তালাকপ্রাপ্তও বটে!
শীর্ষনিউজ