Image description

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নুরেমবার্গ ট্রায়ালের আওয়ায় পড়ে বলে মন্তব্য করেছেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। গতকাল মঙ্গলবার শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে করা মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা মো: আলমগীরকে জেরার সময় আসামি পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেনের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

গতকাল জেরার একপর্যায়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন জানতে চান, শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল কি না? জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা মো: আলমগীর বলেন, হ্যাঁ, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল। তবে পরে নিজের লোক দিয়ে হাইকোর্টে মামলা করে কোটা পদ্ধতি আবার ফিরিয়ে আনেন। তখন আমির হোসেন বলেন, কারা মামলা করেছিল; আপনি কি তাদের নাম বলতে পারবেন? তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, যারা মামলা করেছিল তাদের নাম বলতে পারব না। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, আপনি নাম জানেন না তা হলে বুঝলেন কি করে যে শেখ হাসিনা মামলাটি তার লোক দিয়ে করিয়েছেন? এ সময় তদন্ত কর্মকর্তা চুপ থাকলে আমির হোসেন বলেন, আপনি এ কথাটি অসত্য বলেছেন। জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ইহা সত্য নহে যে, শেখ হাসিনা কাউকে দিয়ে কোটা পুনর্বহালের জন্য হাইকোর্টে মামলা করাননি।

এই পর্যায়ে শেখ হাসিনার আইনজীবী বলেন, শেখ হাসিনা মামলার আদেশ দিবেন না, কারণ এটি আইনে নাই। তখন বিজ্ঞ আদালত আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদের সংবিধান পৃথিবীর সেরা সংবিধানগুলোর একটি। তাও বিগত ৫০ বছর অপরাধ কম হয়েছে? তখন আমির হোসেন বলেন, বিজ্ঞ আদালত যথার্থ বলেছেন। তবে আমার আসামি কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেনি। এই পর্যায়ে প্রসিকিটর মিজানুল ইসলাম বিজ্ঞ আদালতের অনুমতি নিয়ে আসামি পক্ষের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সিনিয়র আমার একটা কথা শোনেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো জার্মানির নুরেমবার্গ ট্রায়াল ও জাপানের টোকিও ট্রায়াল। এই দু’টি বিচার প্রক্রিয়ায় যুদ্ধে কোন পক্ষ আগ্রাসী তা ইস্যু ছিল না। বিষয় ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল কি না। আর আমাদের এখানে জুলাইয়ে যা ঘটেছে, তা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের আওতায় পড়ে।

এ দিকে এ মামলায় বিষয়বহির্ভূত উল্লেখ করে বিভিন্ন থানায় পুলিশ হত্যার বিষয়ে আসামির আইনজীবীকে জেরা করতে দেয়নি প্রসিকিউশন। ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ এ সাক্ষীকে জেরা করার সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে প্রসিকিউশন তা ট্রাইব্যুনালকে বোঝাতে সক্ষম হয়। পরে এ বিষয়ে জেরা করা হয়নি। মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনেও শেষ না হওয়ায় আজ বুধবারও জেরা চলবে। বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ জেরা চলে বেলা সোয়া ১টা পর্যন্ত। ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত অপর বিচারক ছিলেন মো: শফিউল আলম মাহমুদ।

জেরার সময় এক প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা মো: আলমগীর বলেন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে গত ২ অগাস্ট প্রকাশিত ‘গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ৩২ শিশু’ এবং দৈনিক প্রথম আলোতে ৪ আগস্ট প্রকাশিত ‘গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ১৩৩ শিশু’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন তিনি দেখেছেন। এ সংবাদ অন্য অনেক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এ সময় আসামির আইনজীবীর প্রশ্নে জবাবে আলমগীর বলেন, তদন্তকালে উল্লিখিত শহীদ শিশুদের সবার বাড়িতে তিনি যাননি। শুধু একজনের বাড়িতে গেছেন। যে শিশুর বাড়িতে গেছেন, তার বাবা-মায়ের নাম বলতে পারেননি। তবে এসব শিশুর মৃত্যু নিয়ে সঠিক তদন্ত না করার বিষয়ে আসামিদের আইনজীবীর অভিযোগ অস্বীকার করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

আইনজীবী আমির হোসেন সাক্ষীকে বলেন, আলজাজিরা নির্মিত ‘জুলাইয়ের ৩৬ দিন : উন্মোচিত হচ্ছে শেখ হাসিনার গোপন আদেশনামা’ শিরোনামের ৪৯ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র ‘এ আই জেনারেটেড’। এ বক্তব্য সত্য নয় বলে জানান সাক্ষী আলমগীর। আরেকটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে ‘জুলাই রেভ্যুলিউশনারি অ্যালায়েন্স (জেআরএ)’ নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে ৭ আগস্ট প্রকাশিত ৩ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের এ তথ্যচিত্রও এআই নির্মিত বলে মনে করেন আসামির আইনজীবী। তবে সাক্ষী যথারীতি তা অস্বীকার করেন।

আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এ এস এম মাকসুদ কামাল ও হাসানুল হক ইনুর কথোপকথনের সত্যতা পরীক্ষার জন্য আলামতগুলো সিআইডি ব্যতীত দেশী-বিদেশী অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঠাননি।

বিবিসি বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে গত ৯ জুলাই প্রচারিত ৩৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি বর্তমান সরকারের প্রভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে আসামির আইনজীবী উল্লেখ করেন। তবে সাক্ষী তদন্তকারী কর্মকর্তা তা অস্বীকার করেন।

জুলাই আন্দোলনে ২৫ হাজার ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্যে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি মাত্র তিনজন আহত ব্যক্তির জখমি সনদপত্র সংগ্রহ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আইনজীবী তার বিরুদ্ধে অসম্পূর্ণ তদন্ত করার অভিযোগ তুললে তিনি অস্বীকার করেন।

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ এর ৩(২)(এ)(জি)(এইচ) এবং ৪(১)(২)(৩) ধারায় কোনো অপরাধ করেননি বলে আইনজীবী আমির হোসেন উল্লেখ করলে সাক্ষী মো: আলমগীর তা অস্বীকার করেন।

জেরার একপর্যায়ে আইনজীবী আমির হোসেন সাক্ষী মো: আলমগীরকে দেশের বিভিন্ন থানায় পুলিশ হত্যার বিষয়ে বলেন। এ অংশটি ট্রাইব্যুনালে রেকর্ড করা হয়নি। আমির হোসেন বলেন, সিরাজগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, আশুলিয়া, রামপুরা থানায় পুলিশ হত্যা করা হয়েছে। আপনি জানেন কি না? এ সময় সাক্ষী আলমগীর বলেন, এ বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। এ সময় কৌঁসুলি মো: মিজানুল ইসলাম আপত্তি জানান। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এখন তদন্ত কর্মকর্তার আওতাধীন নয়। তাই এটি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। এখানে এটি যাবে না।’ তখন আসামির আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালে এসব ঘটনা ঘটেছে, প্রাসঙ্গিকভাবে আসতেই পারে।’

এ সময় জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘জেরার কোনো লিমিট নেই’। এ পর্যায়ে কৌঁসুলি এম এইচ তামিম ট্রাইব্যুনাল আইন রোল ৫৩/সাবরোল-২ বের করে দেখান যে, সাক্ষীকে জেরা করার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তখন ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনের কথা মেনে নেন।