
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহাবস্থানের সংস্কৃতি ভুলে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছরে উল্টো পথে ছিল কক্সবাজার। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে দুঃশাসনের এক অবর্ণনীয় অধ্যায় দেখেছে জেলার মানুষ। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের অধিকাংশই শান্তিতে ঘরে ঘুমাতে পারতেন না। অন্যের বাড়িতে, নয়তো বিলের মাঝে ধানক্ষেতে রাত কাটাতে হয়েছে অনেককে। দিনটা কোনো রকমে শেষ হলেও পুলিশ কিংবা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার আতঙ্কে রাতের পর রাত খোলা আকাশের নিচে দৌড়ে বেড়াতে হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের। গুম, খুন, গায়েবি মামলা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি-ঘর দখল, লাখ লাখ একর চিংড়িঘের হাতিয়ে নেওয়া, চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা—সবকিছুই হয়েছে পর্যটনের রাজধানীখ্যাত এই নগরে।
আওয়ামী দুঃশাসনের সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের নাম ছিল ক্রসফায়ার। এটিকে নেশা ও পেশায় পরিণত করেছেন ‘টেকনাফের কসাইখ্যাত’ প্রদীপ কুমার দাশ। টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ মাদককারবার নির্মূলের নামে নিজেই কারবারের নিয়ন্ত্রক হয়ে যান। শত শত নিরীহ মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেন ক্রসফায়ারে।
স্থানীয় প্রশাসন ও ভুক্তভোগী পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, কখনো টাকার জন্য, কখনো রাজনৈতিক চাপে বহু মানুষকে খুন করেন প্রদীপ। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের খুনের ঘটনাটি না ঘটলে হয়তো প্রদীপের ক্রসফায়ার বাণিজ্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ওই সময় ওসি প্রদীপ মানেই ছিল রক্তপিপাসু এক দানবের মূর্তিমান আতঙ্ক।
জেলা পুলিশের তথ্য দিতে অপারগতা জানালেও সূত্রের খবর বলছে, কক্সবাজার জেলায় ২৫০টির বেশি ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এমনকি শুধু টেকনাফ উপজেলাতেই ওসি প্রদীপের হাত ধরে ক্রসফায়ারে ২০৪ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া মহেশখালী উপজেলায় ৭ জন ও অন্য উপজেলায় ১০ জন নিহত হয়েছে ক্রসফায়ার কিংবা ‘গোলাগুলি’ নামের সাজানো নাটকে। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, আওয়ামী সরকার আমলে কক্সবাজার জেলায় ২৬৬ জন ক্রসফায়ারে মারা গেছেন।
আর রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে ‘নৃশংস’ ছিলেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জাফর আলম। তিনি ‘বাইট্যা জাফর’ নামেই বেশি পরিচিত। এর পরেই আছেন আলোচিত ‘ইয়াবা গডফাদার’ ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। উখিয়া-টেকনাফের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন এই বদি ও তার নিকটাত্মীয়রা। তার কথার বাইরে টেকনাফ স্থলবন্দরে একজনও ব্যবসা করতে পারতেন না। যারা ব্যবসা করতেন সবাই তারই লোক। আর কক্সবাজার শহরের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র মুজিবুর রহমান।
দলীয় তথ্যমতে, আওয়ামী দুঃশাসনের গত সাড়ে ১৫ বছরে কক্সবাজার জেলায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৯ শতাধিক গায়েবি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়। এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার ও সন্ত্রাসীদের হাতে জামায়াতের ১৪ জন ও বিএনপির সাত নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। আহতের সংখ্যা অগণিত, যার হিসাব বিএনপি-জামায়াত কারো কাছেই নেই।
বিএনপি-জামায়াতের ২১ নেতাকর্মীকে হত্যা
দলীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী দুঃশাসনে জেলায় জামায়াতে ইসলামীর ১৪ ও বিএনপির ৭ জনসহ মোট ২১ নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের প্রতিবাদ করায় গুলিতে মারা যান জামায়াতের ৫ কর্মী।
জামায়াতের তথ্যমতে, আল্লামা সাঈদীর মামলার রায়ের ঘটনায় কক্সবাজার শহরে মারা গিয়েছিলেন তিনজন। অন্য দুজন মারা যান শহরের বাইরে। এছাড়া দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিনজন, পেকুয়া উপজেলায় দুজন, ঈদগাঁওতে একজন, চকরিয়া উপজেলায় দুজন ও মহেশখালী উপজেলায় জামায়াতের একজন মারা যান।
অন্য ৯ জনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামির তথ্য থাকলেও তারা বিস্তারিত জানাতে পারেনি।
অন্যদিকে বিএনপির তথ্যমতে, আওয়ামী দুঃশাসনে জেলায় মারা যাওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ছয়জনই চকরিয়ায় মারা যান। এ ছাড়া একজন মারা যান উখিয়া উপজেলায়।
সূত্র বলছে, চকরিয়া উপজেলায় নিহত ছয়জনের হত্যার সঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) জাফর আলম জড়িত। চকরিয়ায় সংঘটিত প্রতিটি ঘটনাই জাফর আলমের উপস্থিতিতে, নয়তো তার জ্ঞাতসারে হয়েছে। অন্যদিকে উখিয়ায় উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করতে গেলে সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীরা বাধা দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ওই বিএনপি কর্মী মারা যান।
আল্লামা সাঈদের রায়ের প্রতিবাদ করায় গুলিতে ৫ জন খুন
জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আদালতের রায়কে ঘিরে সারা দেশের মতো কক্সবাজারেও বিক্ষোভ মিছিল করতে চেয়েছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। জুমার নামাজ শেষে হাশেমিয়া কামিল মাদরাসা থেকে মিছিল বের হয়। মিছিল বের হওয়ার পরপরই পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় র্যাব। শহরের অন্য মসজিদগুলো থেকেও মুসল্লিরা বের হয়ে এই মিছিলে যোগ দেন। মিছিলে পুলিশের গুলির ঘটনায় পুরো শহর রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এই ঘটনায় পুলিশের গুলিতে কক্সবাজার শহরেই মারা যায় ৩ জন। আহত হন শত শত মুসল্লি।
এছাড়া পেকুয়ায় মাদরাসা ছাত্র সাজ্জাদ ও ঈদগাঁও উপজেলায় রশিদ আহমেদ মারা যান।
ওসি প্রদীপের ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্য’
২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর টেকনাফ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগদানের পর থেকেই টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা হয়ে উঠেছিল মানুষ হত্যার ‘স্বর্গরাজ্য’। যে সড়কটি পর্যটকদের কাছে হয়ে ওঠার কথা আকর্ষণীয় ও মোহনীয় পর্যটন স্পট, সেখানে মেরিন ড্রাইভ নামের সমুদ্র ও পাহাড়ঘেঁষা সুন্দর সড়কটি হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের আরেক নাম। দুই বছরে এই সড়কে ক্রসফায়ারের নামে খুন হয়েছেন শতাধিক মানুষ। মাদক নির্মূলের নামে ‘ক্রসফায়ারে’ মানুষ হত্যা ছিল ওই এলাকার নিত্যদিনের ঘটনা। আর এই হত্যাকাণ্ডের সিংহভাগই ঘটিয়েছেন ওসি প্রদীপ। তার সময়ে টেকনাফে একটি কথা প্রচলিত ছিল—‘রক্তের গন্ধ না পেলে ওসি প্রদীপের ঘুম হতো না।’ সেই প্রদীপের সর্বশেষ শিকার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। তার অপরাধ ছিল—তিনি টেকনাফের পাহাড়ে মাদক পাচার সম্পর্কিত ডকুমেন্টারির শুটিং করেছিলেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র মতে, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানায় যোগদানের পর ২২ মাসে শুধু টেকনাফেই ১৪৪টি ‘ক্রসফায়ারে’র ঘটনা ঘটেছে। এই ১৪৪টি ক্রসফায়ারের প্রতিটি ঘটনায় নিরীহ মানুষকে জড়িয়ে হত্যা, মাদক ও অস্ত্র মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলার সংখ্যাও ৪৩২। এসব ক্রসফায়ারের ঘটনায় ২০৪ জন খুন হয়েছেন।
সূত্র মতে, ক্রসফায়ার নামে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার শিকার অর্ধেকেরই বেশি লাশ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভে। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারও নিঃস্ব হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যাকেই ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়া হতো তাকে ১০-১২ দিন থানাহাজতে আটকে রাখা হতো। আবার মাসের পর মাস থানাহাজতে রেখে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এই সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ না দেওয়ার আশ্বাসে ওই ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে আদায় করা হতো লাখ লাখ টাকা।
আলোচিত একরাম ‘ক্রসফায়ার’
২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে ‘কথিত মাদকবিরোধী’ অভিযানে ক্রসফায়ারে খুন হন টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর একরামুল হক। মেরিন ড্রাইভে নিয়ে হত্যার আগে নিজের মেয়ের সঙ্গে কথোপকথন ও তাকে করা গুলির শব্দ, গুলি খেয়ে তার গোঙানির অডিও রেকর্ড প্রকাশের পর বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ডটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। শুধু দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে ঝড় তুলে এই হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের নজির হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডটি বেছে নেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনেও ইয়াবা সম্রাটখ্যাত বদির হাত ছিল। বদির সঙ্গে একরামের বিরোধ ছিল। সেই বিরোধেই তাকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয় বলে বিশ্বাস অনেকের।
মেজর সিনহা হত্যার পর থমকে যায় ‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভের টেকনাফ অংশে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ সেদিন তারই অধীন পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীকে সঙ্গে নিয়ে সিনহাকে হত্যা করেন। পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী প্রথমে চারটি গুলি করেন। পরে প্রদীপ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে আরো দুটি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
এই হত্যাকাণ্ডের পর টেকনাফ ও উখিয়ায় যে হারে বেপরোয়াভাবে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটছিল তার লাগামে টান পড়ে। মূলত প্রদীপের গ্রেপ্তার হওয়ার পর মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। টেকনাফ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা আস্তে আস্তে এলাকায় ফিরতে শুরু করেন।
৯০০ গায়েবি মামলা, আসামি ২৫ হাজার
কক্সবাজার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শামীম আরা স্বপ্না জানান, আওয়ামী দুঃশাসনে জেলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০০ মামলা গায়েবি মামলা হয়েছে। ওইসব মামলায় অন্তত ১০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। যদিও সরকার পতনের পর অন্তত ২৫০টি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর কক্সবাজার জেলা সেক্রেটারি জাহেদুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনে ৪০০ গায়েবি মামলার শিকার হয়েছেন জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। এসব মামলায় ১৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এসব মামলার মধ্যে ১৩০টি মামলা আদালতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আমলেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। দেশে পটপরিবর্তনের পর ১৮৮টি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যাহার করেছে। অন্য মামলাগুলো প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ গুম ও ৯ বছরের নির্বাসন
২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি ভবন থেকে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে ‘অপহরণ’ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী একটি দল। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ। দীর্ঘ দুই মাস দুদিন পর ওই বছরের ১১ মে সাদা একটি গাড়ি দীর্ঘ যাত্রা শেষে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরের গলফ কোর্স ময়দানে চোখ বাঁধা অবস্থায় সালাহউদ্দিন আহমদকে ফেলে দিয়ে আসে। ওখান থেকে তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় শিলং পুলিশের কাছে পৌঁছান। পরে হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে শিলং আদালতের দ্বারস্থ হন।
২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শিলং জজকোর্ট থেকে তিনি সর্বশেষ বেকসুর খালাস পান। কিন্তু আওয়ামী সরকারের অনাগ্রহ ও আইনি জটিলতায় আটকা পড়ে দীর্ঘ ৯টি বছর শিলং শহরের একটি আবাসিক গেস্ট হাউসেই তাকে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। পরে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট সালাহউদ্দিন আহমদ দেশে ফিরে আসেন।
আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময়ে আরেকটি গুমের ঘটনা ঘটে কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে। ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট রাতে মোস্তাক আহমদ গুম হন। তার বাবা ছিলেন আবদুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির বিশ্বস্ত সহযোগী ও টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ। মনে করা হয়, পারিবারিক বিরোধের কারণে মোস্তাক আহমদকে গুম করা হয়েছে। গুম থেকে তিনি আর ফেরেননি। আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান হয়েও মোস্তাক আহমেদ নিজের জীবনটা রক্ষা করতে পারেননি।
ক্রসফায়ার তালিকায় জামায়াতের ৮ নেতা
আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ে কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আটজন নেতাকে ‘ক্রসফায়ারে হত্যা’র তালিকায় রাখা হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজনকে বিভিন্ন সময়ে আটক করে অস্ত্র উদ্ধারের নামে গভীর রাতে ক্রসফায়ারে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে ফিরেছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
জেলা জামায়াতের দাবি, জেলা জামায়াতের ‘জনপ্রিয়’ ও ‘আন্দোলনমুখী’ ৮ জন নেতাকে ক্রসফায়ারে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তারা হলেন জেলা জামায়াতের তৎকালীন নায়েবে আমির শাহজালাল চৌধুরী, টেকনাফ পৌরসভার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ ইসমাঈল, কক্সবাজার সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বাহাদুর (ভিপি বাহাদুর), ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক জেলা সেক্রেটারি জাহেদুল ইসলাম নোমান, সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সরওয়ার আলম সিকদার ও ঈদগাঁও ছাত্রশিবির নেতা লায়েক ইবনে ফাজেল। এদের মধ্যে শহিদুল আলম বাহাদুরকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও সরওয়ার আলম সিকদারকে প্রদীপ কুমার দাশ ধরে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের নামে ক্রসফায়ারের চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন।
শাহজালাল চৌধুরীকে যেভাবে ক্রসফায়ারে নেওয়ার চেষ্টা হয়
আইনজীবী শাহজালাল চৌধুরী তখন ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর জেলা নায়েবে আমির ও উখিয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তিনি কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী ও উখিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরওয়ার জাহান চৌধুরীর ভাই। তাদের ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন একটু প্রতিবাদী টাইপের। ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনে শাহজালাল চৌধুরীকে প্রশাসনিকভাবে জানানো হয়—তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রগুলোতে যেন নৌকার প্রার্থী কিছুটা হলেও ভোট পান। কিন্তু নির্বাচনে তাদের পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রগুলোতে একটি ভোটও পায়নি আওয়ামী লীগ।
৭ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় উখিয়ায় নিজের বাড়িতে খাবার টেবিলে বসেছিলেন শাহজালাল চৌধুরী। খবর পেয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। বের হওয়ার দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই দুটি অ্যাম্বুলেন্সসহ ১৩টি গাড়ি আসে তার বাড়িতে। সেখানে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ ছাড়াও অন্য বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন।
ছেলে হাসান আল বান্নার ভাষ্যমতে, নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডার মামলার আসামি মেজর আরিফ এই দলে ছিলেন। মেজর আরিফ আম্মাকে বলে—উনি (শাহজালাল) কোথায় আছেন জানালে আমরা হয়তো তাকে বাঁচাতে পারতাম। আম্মা যখন জানেন না বলে আবারও উত্তর দেন, তখন মেজর আরিফ আম্মাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ইনস্ট্রাকশন ছিল তাকে পেলে অনগ্রাউন্ডে শুট করতাম।’
আওয়ামী লীগের দখলবাজি
সে সময় কক্সবাজার জেলাজুড়েই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দখলবাজি ছিল। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বালিয়াড়ি দখল, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ, ক্ষুদ্র ব্যবসা নিজেদের দখলে নেওয়া, লাখ লাখ একর চিংড়িঘের, মাছের ঘের দখল, টেন্ডারবাজি, বালুমহাল দখল, পাহাড় কাটা, অন্যের ব্যবসায় ভাগ বসানোসহ যত ধরনের অপরাধ হতে পারে সবই করেছে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত কয়েকজন নেতার ছত্রছায়ায় দলীয় সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররা। কক্সবাজার শহরে সমুদ্রসৈকতকেন্দ্রিক ব্যবসা ও আবাসিক হোটেলের দখলবাজি ছিল সবচেয়ে বেশি।
সমুদ্র সৈকতের কাছাকাটি ‘ড্রাগন মার্কেট’ আওয়ামী লীগের দখলবাজির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই মার্কেট থেকে এখনো মাসিক হারে টাকা পৌঁছে যাচ্ছে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। মার্কেটটির জমি জোরপূর্বক দখল করে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান ও কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে মার্কেট তৈরি করা হয়েছিল। জেলা প্রশাসন কয়েক দফা উচ্ছেদ করলেও আবারও তারা নতুন করে নির্মাণ করে নিয়েছেন। এখনো তা বহাল তবিয়তে।
এই এলাকায় দখলদারির সঙ্গে নাম জড়িয়েছেন কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের ছোট বোন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনিন সরওয়ার কাবেরী। তার জমি দখল নিয়ে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলায় সব ধরনের দখলের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলম। তার বাইরে গিয়ে কেউ এক কদম মাটিও দখলে নিতে পারেনি। এই উপজেলায় ‘সাদা সোনা’খ্যাত চিংড়িঘেরের অবস্থান হওয়ায় এখানে দখলবাজিও বেশি হয়। হাজার হাজার একর চিংড়িঘের বছরের পর বছর আওয়ামী লীগ নেতারা দখল করে খেয়েছেন।
টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল বহুল আলোচিত-সমালোচিত আবদুর রহমান বদির হাতে। তার সাঙ্গপাঙ্গরাই এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীসহ তার দুই শ্যালকের হাতে ছিল সব ক্ষমতার উৎস। টেকনাফে তাকে সঙ্গ দিয়েছেন বিএনপি থেকে দল পাল্টে আওয়ামী লীগে যাওয়া জাফর আহমেদ। তনি পরে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন। টেকনাফের সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বদির নাম।
জেলার সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এলাকা মহেশখালী। এই দ্বীপ উপজেলাটি নিয়ন্ত্রণ করতেন কক্সবাজার-২ আসনের তৎকালীন এমপি আশেক উল্লাহ রফিক ও মহেশখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র মকছুদ মিয়া। চকরিয়া-পেকুয়ার পর সবচেয়ে বেশি চিংড়িঘের ও লবণ মাঠের দখল হয়েছে মহেশখালী উপজেলায়। সবকিছুতে ওই দুজনের হাত ছিল বলে জানা গেছে।
জুলাই আন্দোলনে ৫ শহীদ
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে গিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কক্সবাজার জেলা থেকে পাঁচজন তরুণ শহীদ হয়েছেন। এদের মধ্যে কক্সবাজার শহরে মারা যান একজন। অন্য চারজনের মধ্যে তিনজন চট্টগ্রাম শহরে। অন্যজন শহীদ হন জেলার ঈদগাঁও উপজেলায়।
রাজনৈতিক নেতারা যা বলছেন
কক্সবাজার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শামীম আরা স্বপ্না বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনে আমাদের একজন নেতাকর্মীও নিজেদের বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। আমাদের জন্য মিছিল-মিটিং করা ছিল একরকম নিষিদ্ধ। শত শত গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলার ভয়ে নেতাকর্মীদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর জেলা সেক্রেটারি জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। জেলার সবখানে আমাদের অফিস বন্ধ ছিল। প্রতিটি গায়েবি মামলাতেই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। দখল করা হয়েছে আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গায়েবি মামলা করা হয়েছে তিনশর কাছাকাছি। তবে আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম কখনোই তারা বন্ধ করতে পারেনি। আমাদের নেতাকর্মীরা সব বাধা উপেক্ষা করে সংগঠনের জন্য কাজ করে গেছেন।’
প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন কুতুবদিয়া প্রতিনিধি এম এ মান্নান, চকরিয়া প্রতিনিধি এ কে এম ইকবাল ফারুক, টেকনাফ প্রতিনিধি তাহের নঈম, ঈদগাঁও প্রতিনিধি আনোয়ার হোছাইন, রামু প্রতিনিধি আহমদ ছৈয়দ ফরমান ও মহেশখালী প্রতিনিধি মকছুদুর রহমান।