
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, দেশের ভেতরে নানা ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও একাধিকবার সতর্ক করেছেন, নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে একটি বিশেষ মহল। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর মেয়াদের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বিস্তারের নানা চেষ্টা এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশ্যে মন্তব্য করছে। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর জাতীয় পার্টিকে শুধু নির্বাচনে আনা নয়, প্রধান বিরোধী দল বানানোর নানা প্রচেষ্টা আছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য নিউ ইয়র্কে সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ অবস্থায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। বিচারকাজ শেষে দলটির ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এই দেশের মানুষ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে নির্বাচন ঘিরে ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপসহ বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সুজাতা সিংয়ের ঢাকায় দৌড়ঝাঁপের দৃশ্য দেশের মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। আবার ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে ড. কামাল হোসেন যে জাতির ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন, তার পেছনে ছিল ভারতের ভুয়া প্রতিশ্রুতি।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাময়িকভাবে ভারতের প্রভাব কিছুটা কমে এলেও দিল্লি যে দাবার গুঁটি নতুন করে সাজাচ্ছে, তা বোঝা খুব কঠিন বিষয় নয়। হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রথমসারির সব নেতা এখন ভারতে অবস্থান করছেন। তারা সেখানে বসে মাছি মারছেন না। সম্প্রতি আমার দেশ-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পলাতক আওয়ামী নেতারা কীভাবে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। এই আওয়ামী নেতারা এখন আর স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। এরা পরিচালিত হচ্ছেন গোয়েন্দা নির্দেশনা অনুযায়ী।
আওয়ামী নেতাদের হাতে থাকা বিপুল অর্থ, প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং বামপন্থির মুখোশ পরে থাকা আওয়ামী সফট পাওয়ার আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজটি এখনই শুরু করেছে। তাদের এখন একটাই লক্ষ্য, ড. ইউনূস সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার সামর্থ্য রাখে নাÑএমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা। ঢাকার রাজনৈতিক বাতাসে এখন আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের গুঞ্জন চলছে। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সেমিনারে অংশ নেওয়ার খবর সংবাদপত্রে আসছে। আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের অর্থ হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করে একটি ভারতপন্থি সেনাসমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অনেকের মুখে এমন কথাও শোনা যায়, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নয়, দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ ধরনের বক্তব্য যে বাংলাদেশকে ঘিরে দিল্লির রাজনৈতিক ছকের অংশ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে দিল্লির প্রধান টার্গেট হচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্র পরিচালনায় ড. ইউনূস সরকারের নানা ব্যর্থতা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মমর্যাদা বোধ ফিরিয়ে এনেছেন। এক বছরে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার ক্ষেত্রে ভারত যে আমাদের প্রধান শত্রু, ড. মুহাম্মদ ইউনূস তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পর এই প্রথম একজন সরকারপ্রধান পেয়েছেন, যিনি অন্তত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করেছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই বলেছেন, তিনি ড. ইউনূসের মধ্যে জিয়াউর রহমানের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।
এ কারণে আমরা দেখছি, ভারতপন্থি গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও ভারতের মিডিয়ার আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরাই ঢাকার বাতাসে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন কিংবা নির্বাচনকালীন সরকারের গুজব ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতিতে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রেক্ষাপট আমাদের আবার স্মরণ করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা থেকে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার এসেছিল। এ সরকারের পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় সম্মিলিত সমর্থন। ছদ্মবেশী এই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে শুধু সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ কিংবা ফখরুদ্দীন আহমদ নন, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা জড়িত ছিলেন।
রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া কখনো সেনানিয়ন্ত্রিত অনির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতা গ্রহণের সাহস পান না। বেগম খালেদা জিয়ার আনুগত্য পরিত্যাগ করে ওয়ান-ইলেভেন ঘটানোর সঙ্গে বিএনপির প্রথমসারির নেতারা জড়িয়েছিলেন। এমনকি তারেক রহমানের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি জানার পরও তারা ছিলেন নিশ্চুপ। এমন কথাও শোনা যায়, তারেক রহমানেরও ওপর নির্যাতনের জন্য তারা সমর্থন জুগিয়েছেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপি নেতারা জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে থাকেন। নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপি যদি অনড় অবস্থান নিত, তাহলে জামায়াত অংশ নিলেও সে নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পেত না। জামায়াত এ সময় ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের ফাঁদে পড়েছিল। অথচ ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিন দায়িত্ব নেওয়ার পর বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মতিউর রহমান নিজামী প্রথম দাবি করেছিলেন, দেশে একটি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াত নেতারা সেনা শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দূরে থাক, বিএনপির বড় একটি অংশ আঁতাত করে নতুন বিএনপি তৈরি করেছিলেন। শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত আমলা ও সেনা কর্মকর্তারাও এর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। খোন্দকার দেলাওয়ার হোসেনের মতো কয়েকজন ত্যাগী নেতা অসীম সাহস দেখিয়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সে সময়ের প্রসঙ্গ এ কারণে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন যদি চরম রূপ নেয় এবং প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা যদি ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। এর ফল কারো জন্য শুভ হবে না। হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের শুরু হয়েছিল মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন আহমদের শাসনের মাধ্যমে। প্রণব মুখার্জি তার দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স বইয়ে শেখ হাসিনা ও মঈন উ আহমেদের ওপর তার প্রভাব বিস্তারের বিবরণ দিয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল ভারতের একটি ভাসাল স্টেট। আবার যদি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি এ ধরনের ফাঁদে পড়ে, তাহলে বাংলাদেশে জুলাইয়ের চেয়ে আরো বহুগুণ রক্তাক্ত পরিস্থিতির মধ্য পড়তে হবে। চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব হারাবে। মনে রাখতে হবে, বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়া কখনো বিদেশি মদতপুষ্ট সেনানিয়ন্ত্রিত সুশীল সমাজ ক্ষমতা দখলের সাহস দেখাতে পারবে না।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতপন্থিরা কোনো বিশেষ বাহিনীর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সাহস দেখাবে বলে মনে হয় না। এমনটা হলে ৭ নভেম্বর-পরবর্তী সময়ে খালেদ মোশাররফের পরিণতি অনেককে বহন করতে হবে। কারণ এ দেশের তরুণদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দেড় দশকের নিপীড়নমূলক শাসনের অবসান ঘটানো হয়েছে। তারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পর্যন্ত এই তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারছে না। তবে এই তরুণরা এ দেশের শত্রু-মিত্রদের ভালোভাবে চিনেছেন। ফলে ভারতপন্থি যেকোনো প্রচেষ্টা যে এই তরুণরা রুখে দেবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের মানুষ একটি বিষয় ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে, হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্র হত্যা থেকে শুরু করে নিপীড়নমূলক শাসন কায়েম এবং লুটপাটের যে রাজনীতি চালু করেছিলেন, তা সম্ভব হয়েছিল ভারতের সমর্থনের জোরে। ফলে দিল্লির রাজনৈতিক ছকে কোনো দল পা দিয়েছে কি না সেদিকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি থাকবে। আগামী নির্বাচনে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভারত প্রশ্নে কী নীতি গ্রহণ করে, তা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠবে।
আলফাজ আনাম