Image description
 

বাংলাদেশে গত দেড় দশক ধরে চালানো তথাকথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানগুলো মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস, জাতীয় নির্বাচন অথবা রাজনৈতিক উত্তেজনার আগমুহূর্তে হঠাৎ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘জঙ্গি আস্তানা’র সন্ধান, ‘বড় হামলা নস্যাৎ করা হয়েছে’Ñএমন খবর প্রচার করা হতো।

 

প্রেস ব্রিফিংগুলো ছিল প্রায়ই একই ভাষায়—‘বড় হামলার পরিকল্পনা ভেঙে পড়েছে’, ‘ষড়যন্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে’, ‘জঙ্গিদের জাল উপড়ে ফেলা হয়েছে’। অথচ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে কোনো বড় জঙ্গি হামলা, অভিযান বা জঙ্গিবিরোধী কোনো নাটক দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতি এক জটিল প্রশ্নকে সামনে এনেছে তা হলো—এতদিন ধরে যাদের ‘সক্রিয় জঙ্গি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল তারা হঠাৎ করে কোথায় গেল?

 

আওয়ামী লীগ ব্যর্থতা ঢাকতে রাষ্ট্রীয় মদতে একের পর এক জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করে। ওই আমলে এমন একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ যেন জঙ্গির অভয়ারণ্য। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ঘটনার ধারাবাহিকতা দেখলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের অসারতা ফুটে ওঠে। ২০০৯-১০ সালে জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের নামে প্রথম দফা গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়। ২০১১ সালে রাজশাহী, দিনাজপুর ও ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বিস্ফোরক উদ্ধার এবং ২০১৩ সালে শাহবাগ-হেফাজত উত্তাপের সময়ে নানা স্থানে নাটকীয় গ্রেপ্তার-নির্দেশনা ছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে অনেককে ‘জঙ্গি সন্দেহে’ আটক করা হয়; ব্লগার হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন অভিযানে অনেককেই হত্যা করা হয় বন্দুকযুদ্ধে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর অনেক অপারেশন চালানো হয়। ‘থান্ডারবোল্ট’, ‘শোলাকিয়া’, ‘সানডেভিল’, ‘ইগল হান্ট’ ইত্যাদি। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সময়ে সিলেটের শিববাড়ি, আশকোনা, কল্যাণপুর, গাজীপুরসহ জেলায় জেলায় অভিযানে অনেক তরুণকে জঙ্গি তকমা দিয়ে হত্যা করা হয়। কোভিডকালে বড় আকারের হামলার নাটক না থাকলেও গ্রেপ্তার অভিযান চালু ছিল; ২০২৩-২৪ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিবসের আগে হঠাৎ করে ‘জঙ্গি গ্রেপ্তারের নাটক’ দফায় দফায় দেখা গেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর এ ধরনের ঘটনা আর দেখা যায়নি।

প্রতিটি ঘটনার প্যাটার্ন ছিল একই

হাসিনার জমানায় প্রতিটি ঘটনায় একটি মৌলিক প্যাটার্ন দেখা গেছে। প্রেস ব্রিফিংয়ের একই ধরনের বর্ণনা, নিহতদের কখনই জীবিত অবস্থায় আদালতে হাজির না করা, মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকা এবং প্রমাণের স্বচ্ছতার অভাব। অনেক পরিবারের অভিযোগ, তাদের সন্তানরা বিচ্ছিন্নভাবে বা কয়েক মাস আগে থেকেই নিখোঁজ থাকলেও পরবর্তী সময়ে সংবাদে ‘অভিযানে নিহত’ দেখানো হয়। কিছু ক্ষেত্রে মামলা-নথি ও চার্জশিট বিশ্লেষণে স্পষ্ট ফাঁক দেখা গেছে। র‌্যাব, সিটিটিসি, ডিবি—এই সংস্থাগুলো অভিযানে প্রধান ভূমিকা পালন করলেও কিছু গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরে স্বীকারও করেছেন যে রাজনৈতিক চাপ ছিল। এমনকি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার অভিযোগও মিলেছে।

হাসিনার ‘জঙ্গি কার্ড’ নীতিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে তরুণদের। যাদের ‘নিহত’ বলা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই ছিল ছাত্র, চাকরিপ্রার্থী বা দিনমজুর। সাধারণ মানুষ কেমন করে ‘সক্রিয় জঙ্গি’ হয়ে ওঠে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। জঙ্গি তকমায় গুম হওয়া বহু মানুষের পরিবারের একই অভিযোগ, তাদের সন্তানকে আগে অপহরণ করা হয়েছে, পরে ‘অভিযানে নিহত’ হিসেবে সরকারি বর্ণনায় উপস্থাপন করা হয়। নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, সিলেটের শিববাড়ি— এসব কেস স্টাডি থেকে উঠে আসে একই প্যাটার্ন, অর্থাৎ নিখোঁজের পর ‘অভিযানে জঙ্গি নিহত’ হওয়ার বর্ণনা।

রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যাপারটি আরো সুস্পষ্ট। জঙ্গি কার্ড ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামপন্থি বা বিরোধী সংগঠনগুলোকে দমন করা, জনমনে ভয় সৃষ্টি করে সরকারের টিকে থাকার বৈধতা তৈরি করা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নিজেকে ‘জঙ্গিবিরোধী নেতা’ হিসেবে পরিচয় করানো। এই উদ্দেশ্যগুলো বারবার চোখে পড়ে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও বিভিন্ন সময় এসব অভিযানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

আমার দেশের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এসব অভিযানের বড় অংশই ছিল কৃত্রিমভাবে তৈরি গল্প। পাশাপাশি এসব ‘জঙ্গি কার্ড’ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃতি পেতে ও বিরোধী শক্তিকে দমন করতে এমন কৌশল নিয়েছিল হাসিনার সরকার।

জঙ্গিকার্ড নিয়ে সবার সন্দেহ

সাজানো জঙ্গি নাটক নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এবং পুলিশ কমিশনারও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির ৩৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আলোচনা সভায় খালেদা জিয়া বলেন, ‘এই সরকার কথায় কথায় কিছুদিন পরপর জঙ্গির ধুয়া তুলে। অমুক জায়গায় এতজন জঙ্গি পাওয়া গেছে। তারপর জঙ্গিগুলো ধরে, সত্যিকার জঙ্গি কি না জানি না। কিছু লোক তাদের ধরা থাকে। এগুলো না খেয়ে খেয়ে দীর্ঘদিন বন্দি করে রেখে তাদের দাঁড়ি-চুল বড় করে, বিদঘুটে চেহারা হয়ে যায়। তারপর তাদের জঙ্গি বলে সামনে নিয়ে আসে। কিছুদিন পর দেখা যায়, তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়।’

এমনকি ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টেও র‍্যাব, সিটিটিসি-র নানা অভিযানকে সন্দেহজনক হিসেবে দেখা হয়েছিল। স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের ২০১৯ সালের কান্ট্রি রিপোর্টে উল্লেখ করে, বাংলাদেশ পুলিশের কিছু অংশ সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় ও অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে। এসব অভিযানে বহু সন্দেহভাজনের মৃত্যু ঘটে, যেগুলোকে অনেক সময় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’ বলে বর্ণনা করা হয়, যা প্রায়ই বিচারবহির্ভূত হত্যার আড়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পর্যবেক্ষকরা কিছু অভিযানের সত্যতা ও গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এসবকে কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাজানো ঘটনা বা গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট উপস্থাপনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো ধরনের জঙ্গি বা জঙ্গিবাদ নেই।’ অপর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে জঙ্গিবাদের কোনো উত্থান হয়নি।’

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী চলতি বছর হোলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার ৯ বছর পূর্তিতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি নেই। আওয়ামী লীগের সময় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ছেলেপেলেদের মারছে ।’

জঙ্গিরা সব গেল কোথায়

রাজনৈতিক পালাবদলের পর হঠাৎ করে জঙ্গিদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া কয়েকটি সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। প্রথমত, যাদের এতদিন ‘সক্রিয় জঙ্গি’ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে, তাদের বড় অংশের আদৌ অস্তিত্ব ছিল না। তারা ছিল সাজানো নাটকের চরিত্র, যাদের বানিয়ে তোলা হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।

দ্বিতীয়ত, প্রকৃতপক্ষে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাদের অনেককে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, কিছু ব্যক্তি হয়তো সাময়িকভাবে চরমপন্থার দিকে ঝুঁকেছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ফিরে গেছে। রাষ্ট্রীয় দমননীতি থেমে যাওয়ায় আর নতুন করে কোনো ‘উত্থান’ দেখা যায়নি।

চতুর্থত, আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবে যেসব গোষ্ঠীকে বড় করে দেখানো হতো, সেগুলো কার্যত ভেঙে পড়েছে বা অস্তিত্ব হারিয়েছে।

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম আমার দেশকে বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান মূলত ভারতীয় বয়ান এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার ছিল। বাংলাদেশে জঙ্গিদের উত্থান হচ্ছে, এদের দমাতে না পারলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা তৈরি হবে—এভাবে ভারতীয়দের সহায়তায় ইউরোপ এবং আমেরিকাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সফলও হয়েছে। এ কারণে বহির্বিশ্ব থেকে বড় ধরনের কোনো চাপের মুখে পড়তে হয়নি হয়তো। বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান রোধে আওয়ামী সরকার দরকার বলে বহির্বিশ্বের অনেক দেশকে বুঝাতে চেয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার।’

শেখ হাসিনার আমলে নিপীড়নের শিকার ‍মুফতি হারুন ইজহার আমার দেশকে বলেন, অবৈধ ক্ষমতার মসনদকে টিকিয়ে রাখতে বিদেশিদের কাছে হাসিনা জঙ্গিফোবিয়া তৈরি করে নিজেকে মৌলবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে জাহির করে। আর এজন্য তার প্রয়োজন পড়ে জঙ্গি নাটকের। এমন নাটকের প্রাসঙ্গিকতাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে জুলাই বিপ্লব।

সাবেক জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অ্যাডভোকেট শেখ ওমর আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি নাটকে সরাসরি ভারতের তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগ সরকার জড়িত ছিল বলে বহু তথ্য ও প্রমাণ বের হয়েছে। জঙ্গি উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ায় ডিজিএফআইয়ের ভূমিকা ছিল বলেও অনেক অভিযোগ রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে ভারতের প্রযোজনায় ফের ওই ধরনের জঙ্গি নাটক সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। তাই সামনের সময়গুলোতে বাংলাদেশে কথিত জঙ্গি নাটকের হোতারা পুনরায় সক্রিয় হতে পারে।